sep

Guru Tattwas Guru Mahima

বিভিন্ন শাস্ত্র গ্রন্থে গুরু তত্ত্ব ও গুরু মহিমা সম্বন্ধে যা যা বর্ণনা করা হয়েছে, তা সম্বন্ধে নীচে বিশদ ভাবে বিবরণ দেওয়া হলো ।

Capture

রুদ্রযামলে –

অনন্তর গুরু ও শিষ্যের কর্ত্তাব্যাকর্ত্তব্য কথিত হইতেছে । – রুদ্রযামলে কথিত আছে, যে, – কদাচ গুরুর আজ্ঞা লঙ্ঘন করিবে না এবং সহসা কোন বাক্যের প্রত্যুত্তর প্রদান করাও উচিত নহে। দিবানিশি দাসের ন্যায় গুরুর আজ্ঞা প্রতিপালন করিবে ।।

Capture

সারসংগ্রহে –

লিখিত আছে, যে, – সদ্ গুরু আশ্রিত শিষ্যকে একবৎসর পর্য্যন্ত পরীক্ষা করিয়া তৎপরে মন্ত্র প্রদান করিবে। কিন্তু স্বপ্নলব্ধ মন্ত্রে কালাকাল বিবেচনার আবশ্যক নাই। যেরূপ অমাত্যকৃত পাপ রাজায় এবং পত্নীকৃত পাপ পতিতে সংক্রান্ত হয়, তদ্রূপ গুরুও শিষ্যকৃত পাপে অভিভূত হইয়া থাকেন। এক বৎসরে ব্রাহ্মণ, দুই বৎসরে ক্ষত্রিয়, তিন বৎসরে বৈশ্য এবং চারি বৎসরে শূদ্রশিষ্য-যোগ্যতা প্রাপ্ত হয় ।।

Capture

তারাপ্রদীপে –

লিখিত আছে, যে, – মন্ত্রের অক্ষর সকলকে দেবতাস্বরূপ এবং সেই দেবতাকে গুরুস্বরূপ বিবেচনা করিবে, কদাচ তাহাদিগের ভেদজ্ঞান করিবে না ।।

Capture

রুদ্রযামলে –

লিখিত আছে, যে, – যদি গুরুর দ্রব্য গ্রহণে অভিলাষ করে অথবা গুরুপত্নী গমন করে, তাহা হইলে সেই ব্যক্তি মহাপাতকে লিপ্ত হয়, কোনরূপ প্রায়শ্চিত্তে তাহার পাপের শান্তি হয় না। যে ব্যক্তি গুরুর নিন্দা শ্রবণ করে, তাহার সেই দিনকৃত পূজা দেবী গ্রহন করেন না।।

Capture

কুলার্ণবে –

কথিত আছে, যে, – যদি কোন স্থানে গুরুর নিন্দা শ্রুতিগোচর হয়, তাহা হইলে কর্ণদ্বয় আবৃত করিয়া তৎক্ষণাৎ তথা হইতে দূরে গমন করিবে, যেন আর সেই সকল দুর্বাক্য কর্ণগোচর হইতে না পারে।।

Capture

নিত্যানন্দে –

লিখিত আছে, যে, – মনুষ্যবৎ জ্ঞান করিবে না, যদি গুরুকে মনুষ্য বলিয়া জ্ঞান করা যায়, তাহা হইলে কি মন্ত্রজপ, কি পূজা কিছুতেই সিদ্ধিলাভের সম্ভাবনা নাই। যদি গুরু একগ্রামে অবস্থিতি করেন, তাহা হইলে শিষ্য প্রতিদিন ত্রিসন্ধ্যা তাঁহাকে প্রণাম করিবে, গুরু এক ক্রোশ দূরে অবস্থিত হইলে প্রতিদিন একবার তাঁহার নিকট গিয়া প্রণাম করিবে। গুরু অর্দ্ধযোজন দূরে থাকিলে শিষ্য পঞ্চ পর্ব্বে গিয়ে বন্দনা করিবে, যদি এক যোজন হইতে দ্বাদশ যোজন মধ্যে অবস্থিতি করেন, তাহা হইলে যোজনসংখ্যক মাসে গিয়া প্রণাম করিবে। যদি গুরুদেব অতি দূরদেশে থাকেন, তাহা হইলে প্রতি বর্ষে বর্ষে এক এক বার গিয়া শিষ্য তাঁহার চরণ বন্দনা করিবে।।

Capture

জামলে –

জামলে লিখিত আছে, যে, – যে ব্যক্তি গুরুর নিন্দা করে, সে গতশ্রী ও গতায়ু হইয়া শতকোটি কল্প নরকে নিমগ্ন থাকে।।

Capture

পুরশ্চরণরসোল্লাসে –

লিখিত আছে, যে, – গুরুকে সর্বদা শিবময় ভাবনা করিবে। গুরু পুত্রকে গণেশসদৃশ, বধূকে লক্ষ্মী ও সরস্বতী ন্যায় এবং গুরুর কুল ভৈরবগণ সদৃশ বিবেচনা করিতে হয়।।

Capture

বৃহন্নীলতন্ত্রে –

লিখিত আছে, যে, – গুরুর অভাবে গুরুপত্নীর অর্চ্চনা করিবে। তাঁহার অভাবে গুরুপুত্র, গুরুপুত্রের অভাবে গুরুকন্যা, গুরুকন্যার অভাবে গুরুস্নুষা এবং এই সকলের অভাবে গুরুবংশীয় অপরের পূজা করিবে। যদি তদ্ধংশীয়গণেরও অভাব হয়, তাহা হইলে গুরুর মাতামহ, মাতূল ও মাতুলানীর পূজা করিতে হয়।।

Capture

গুরুগীতা –

লিখিত আছে, যে, – যে ব্যক্তি প্রতিদিন ভক্তিসহকারে গুরুর পাদোদক পান করেন, তিনি সার্দ্ধত্রিকোটি তীর্থের ফল প্রাপ্ত হন।।

Capture

পুরশ্চরণরসোল্লাসে –

লিখিত আছে, যে, – গুরুকে সর্বদা শিবময় ভাবনা করিবে। গুরু পুত্রকে গণেশসদৃশ, বধূকে লক্ষ্মী ও সরস্বতী ন্যায় এবং গুরুর কুল ভৈরবগণ সদৃশ বিবেচনা করিতে হয়।।

Capture

বৃহন্নীলতন্ত্রে –

লিখিত আছে, যে, – গুরুর অভাবে গুরুপত্নীর অর্চ্চনা করিবে। তাঁহার অভাবে গুরুপুত্র, গুরুপুত্রের অভাবে গুরুকন্যা, গুরুকন্যার অভাবে গুরুস্নুষা এবং এই সকলের অভাবে গুরুবংশীয় অপরের পূজা করিবে। যদি তদ্ধংশীয়গণেরও অভাব হয়, তাহা হইলে গুরুর মাতামহ, মাতূল ও মাতুলানীর পূজা করিতে হয়।।

Capture

কুলার্ণবে –

লিখিত আছে, যে, – গুরুর পাদুকা, ছত্র, শয্যা ও ভূষণাদি দর্শন মাত্র নমস্কার করিবে, সেই সমস্ত দ্রব্য কদাচ নিজে ভোগ করিবে না।।

Capture

গুরুগীতা –

কথিত আছে, যে, – গুরু যেরূপ উপদেশ প্রদান করিবেন, তাহাতেই মনঃশুদ্ধি করিবে। গুরু সৎই বলুন আর অসৎই বলুন তাঁহার আজ্ঞা লঙ্ঘন করা উচিত নহে। গুরুর নিকট কদাচ মিথ্যা বাক্য প্রয়োগ করিবে না।।

Capture

পিচ্ছিলাতন্ত্রে –

লিখিত আছে, যে, – যে ব্যক্তি ধর্ম্মবিমোহিত হইয়া পৈতৃক কুরুকুল পরিত্যাগ করে, সেই ব্যক্তি যে পর্য্যন্ত চন্দ্রসূর্য ধরাতলে অবস্থিত থাকে, তাবৎ কাল ঘোর নরকে পতিত হয়।।

Capture

জামলে –

লিখিত আছে, যে, – গুরু, গুরুপুত্র, গুরুপত্নী ও গুরুর বন্ধুগণের দোষ কদাচ প্রকাশ করিবে না; ইঁহাদিগের কোন দ্রব্য ভক্ষণ করা উচিত নহে। কিন্তু তাঁহারে আপন ইচ্ছানুসারে প্রদান করিলে তাহা ভক্ষণ করিতে পারে।।

Capture

কুলাগমে –

লিখিত আছে, যে, – যদি পূজাকালে গুরু, গুরুপত্নী বাঁ গুরুপুত্র সমাগত হন, তাহা হইলে পূজা পরিত্যাগ পূর্ব্বক তাঁহাদিগেরই অর্চ্চনা করিবে; ইহাই শাস্ত্রের সিদ্ধান্ত। সেই দিন শিষ্যের পক্ষে কোটি সূর্য্যগ্রহণের তুল্য। হে দেবি ! চন্দ্রগ্রহণ দিবসের ন্যায় সেই দিন শিষ্যের পক্ষে পরম শুভপ্রদ জানিবে।।

Capture

মুন্ডমালাতন্ত্রে –

লিখিত আছে, যে, – গুরুর পূজা না করিয়া যে ব্যক্তি ইষ্টদেবতার অর্চ্চনা করে, ভৈরব স্বয়ং তাহার মন্ত্রের তেজ হরণ করেন।।

Capture

রুদ্রযামলে –

লিখিত আছে, যে, -শিষ্য গুরুর সহিত কোন দ্রব্যের ক্রয় বিক্রয় বাঁ গুরুকে ঋণদান অথবা গুরুর নিকট হইতে ঋণ গ্রহণ করিবে না।।

Capture

বাবাঠাকুর –

গুরুবোধের অনুশীলন দ্বারা গুরুকৃপায় চৈতন্যস্বরূপের দর্শন অনুভূতি হয়। এই চৈতন্যস্বরূপ অর্থাৎ সচ্চিদানন্দ আত্মাই হল জীবজগৎ মানুষ দেবতা ঈশ্বর সবারই মূল উৎস ও উপাদান। এই সত্য পরিচয় সকলেরই হৃদয়ের গভীরে নিহিত আছে। ইহা দেওয়া-নেওয়া ও পাওয়ার বস্তু নয়। ইহা হারায়ও না। অবিদ্যা অজ্ঞান বশত শুধু ইহার স্মৃতি বিস্মৃত হয়ে যায় এবং কল্পিত ভেদজ্ঞানের ধারণার জন্য ঈশ্বর-আত্মার ভেদকল্পনা হয়। এই ভেদকল্পনাই হল অন্তরের মল।।

Capture

বাবাঠাকুর –

তিনি বলেন – “গুরুর স্বরূপ যখন অদ্ধয়, অব্যয়, সচ্চিদানন্দঘন, অখন্ডমন্ডলাকার এবং পরমেশ্বর, পরমাত্মা, পরব্রহ্ম, সনাতন, স্বতঃসিদ্ধ, স্বতঃস্ফূর্ত, অনন্য, স্বয়ং এবং সর্বাত্মা, স্ববোধে বা আপনবোধে নিত্যসিদ্ধ তখন এমন কোন বস্তু নেই যা গুরুর বাইরে আছে। পরব্রহ্ম পরমাত্মা পরমেশ্বর তত্ত্বই হল গুরুতত্ত্ব। সদ্‌গুরু হলেন Existence, Consciousness and Bliss Absolute।।”

Capture

বাবাঠাকুর –

“গুরুতত্ত্বই (জ্ঞান) হল সর্বোত্তম তত্ত্ব; অর্থাৎ গুরুতত্ত্বের অধিক কোন তত্ত্বই নেই। গুরুসেবাই হল উত্তম তপস্যা; তদপেক্ষা উত্তম কোন তপস্যা নেই। সর্বপ্রকার তপস্যার পরিসমাপ্তি হয় সদ্‌গুরু সেবাতে। সদ্‌গুরু শরণাগত ভক্ত ও আশ্রিত জনের জন্মজন্মান্তরের সঞ্চিত কর্মফলকে বাঁ সংস্কারকে আত্মজ্ঞানরূপ অগ্নি দ্বারা দগ্ধ করে দেন। গুরু স্বয়ং কৃপা করে শরণাগত ভক্তকে অসত্য হতে সত্যে নিয়ে যান, তমোরূপ অজ্ঞান হতে জ্ঞানালোকে নিয়ে যান এবং মৃত্যুলোক থেকে উদ্ধার করে অমৃতলোকে নিয়ে যান। তাঁর আশিস্‌ পেয়ে জীব ধন্য হয়। তাঁর কৃপায় জীবের সর্বকর্ম সিদ্ধ হয়। তাঁর করুণার প্রভাবে জীব পরাজ্ঞান বৈরাগ্য ও শুদ্ধাভক্তির অধিকারী হয়। তাঁর অনুকম্পায় জীব গুণমুক্ত হয়ে অমৃতত্ব লাভ করে এবং অদ্বয় অব্যয় শাশ্বত নিত্য পূর্ণ শান্তিময় স্বরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়।।”

Capture

বাবাঠাকুর –

তিনি বলেন, “আত্মবিদ্যা হল গুরুমুখী বিদ্যা। ইহার অপর নাম মধুবিদ্যা, গুপ্তবিদ্যা, ব্রহ্মবিদ্যা, উপনিষদ বিদ্যা, সারস্বত বিদ্যা, অধ্যাত্মবিজ্ঞান, ঈশ্বরীয় বিজ্ঞান, প্রজ্ঞানের বিজ্ঞান ইত্যাদি। সদ্‌গুরুর স্বরূপ এবং তাঁর ইচ্ছা ও শক্তির পরিচয় সাধুসন্ন্যাসী এমনকি দেবতাদেরও দুর্বোধ্য। সাধারণ মানুষের পক্ষে তা ধারণাতীত, ইহা বলাই বাহুল্য। কিন্তু কৃপা করে সদ্‌গুরু তাঁর আপন মহিমা ভক্ত হৃদয়ে ব্যক্ত করেন, তার ফলে ভক্ত গুরুতত্ত্ব অবগত হয়ে গুরুময় হয়ে যায়। গুরুসত্তা ও গুরুশক্তির বাইরে কোন কিছুই এবং কোন জীবনের পৃথক অস্তিত্ব ও বিকাশ সম্ভব নয়। সর্বজীবনের ও সর্বপ্রকাশের মূলে গুরুসত্তা ও গুরুশক্তি নিহিত আছে। ইহা অবগত হওয়াই হল গুরুভজনের লক্ষ্য। এই জ্ঞানই হল আত্মজ্ঞান।।”

Capture

শ্রীশ্রীবাবাঠাকুর বলেন –

“শরণাগত ভক্ত ও আশ্রয়প্রার্থী সন্তানের অন্তরের জন্মজন্মান্তরের সংস্কার অনুসারে সদ্‌গুরু কৃপা করেন এবং অধ্যাত্ম বিদ্যা শিক্ষা ও দীক্ষা দান করেন। সদ্‌গুরুর দেহ অতি পবিত্র, বিশুদ্ধ ও চিন্ময়। তা হতে চিদানন্দের স্পন্দন সব সময়ই চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে। সদ্‌গুরু যেখানে অবস্থান করেন সেই স্থানই মহাতীর্থ। তাঁর সঙ্গলাভ করা অর্থাৎ তাঁর পাশে স্বল্প ক্ষণের জন্যও অবস্থান করার সুযোগ পাওয়া বহু সুকৃতি এবং ভাগ্য, গুরুকৃপার ফলেই তা সম্ভব হয়।।”

Capture

শ্রীশ্রীবাবাঠাকুর গুরুসেবা প্রসঙ্গে বলেছেন-

“গুরুসেবা ত্রিবিধ-তামসিক, রাজসিক ও সাত্ত্বিক। তামসিক সেবা স্থূলবস্তু সাপেক্ষ অর্থাৎ স্থূলবস্তুর মাধ্যমে গুরুর সেবা করা। রাজসিক সেবা হল গুরু-নির্দ্দিষ্ট কর্ম সম্পাদনের মাধ্যমে গুরুর সেবা করা। সাত্ত্বিক সেবা হল গুরুজ্ঞানে সব কিছুর ব্যবহার করা অর্থাৎ স্ববোধে, আপনবোধে বা সমবোধে অন্তরে বাইরে সবকিছু মেনে মানিয়ে চলা…।”

Capture

বাবাঠাকুর –

“গুরুবোধে হয় গুরুসেবা, লঘু বোধে হয় গুরুর অবমাননা। পরনিন্দা পরচর্চা ও পরদোষদৃষ্টি দ্বারা গুরুসেবা হয় না। ইহা গুরুসেবার বিরোধী।।”

Capture

বাবাঠাকুর –

তিনি বলেন – “গুরুনিন্দা মহাপাপ। গুরুর সমালোচনা করাও মহাপাপ। শাস্ত্র ও ধর্মের নিন্দা ও বিদ্বেষ দ্বারা এবং দেব-দ্বিজ, সাধু-সন্ন্যাসী ও অন্যান্য গুরু মহারাজদের নিন্দা অবজ্ঞা ও সমালোচনার দ্বারা সদ্‌গুরু প্রতি চরম আঘাত করা হয়। ইহার ফলে নিন্দুকের বিশেষ ক্ষতি হয়। গুরুভক্তের পক্ষে গুরুনিন্দা ব্রহ্মহত্যা তুল্য জ্ঞান করা উচিত…।”

Capture

বাবাঠাকুর –

“গুরুচিন্তার মাধ্যমে সাধকের মধ্যে গুরুশক্তি কাজ করে। সমবোধের চিন্তায় সাধকের মনে বোধের শক্তি ক্রিয়া করে। গুরুবোধ তথা পূর্ণ সমবোধের সঙ্গে সাধকের চিত্তের পরিপূর্ণ মিলন হলে সাযুজ্য যোগের মাধ্যমে গুরুবাত্মৈক্যবোধ প্রতিষ্ঠা হয়। এইরূপ একাত্মবোধই হল সর্ব সাধ্যসাধনের পরাকাষ্ঠা। ইহারই অপর নাম ব্রাক্ষীস্থিতি বা ব্রহ্মাত্মযোগে প্রতিষ্ঠা…।””

Capture

বাবাঠাকুর –

শ্রীশ্রীবাবাঠাকুর একদিন ভক্তদের উদ্দেশ করে গুরুবাদ প্রসঙ্গে বলেন, “গুরুর মধ্যে তোমরা ভেদজ্ঞান করো না। তাঁকে অখন্ডবোধে ভজনা করবে।”

Capture

দীক্ষা দানের রহস্য বা তাৎপর্য সম্বন্ধে শ্রীশ্রীবাবাঠাকুরের কথার অংশবিশেষ উদ্ধৃত হল –

“সদ্‌গুরুর জীবন হল পূর্ণ দীক্ষার জীবন, অর্থাৎ আত্মদানের জীবন। তাঁরা ব্যষ্টি জীব সন্তানের অহংকাররূপ মলিনতা গ্রহণ করে আপনার শুদ্ধস্বরূপ দান করেন। আত্মদানই হল পূর্ণ দীক্ষা দান। সদ্‌গুরুর কাছে আপন অহংকার সঁপে দিয়ে সদ্‌গুরুর দেওয়া আত্মজ্ঞান গ্রহণ করাই হল সত্যের দীক্ষা গ্রহণ করা। স্ববোধে সতত সব মানাই হল আত্মজ্ঞান লাভ করা বা সত্যদীক্ষা গ্রহণ করা ।”

Capture

গুরুর পদবী গ্রহণ সম্বন্ধে অনেকের প্রশ্ন ও অনুরোধে তিনি বলেছেন –

“সদ্‌গুরু স্বয়ং সর্বতত্ত্বময় অর্থাৎ তিনি সর্বদেবময়, সর্ব আত্মময়, সর্বেশ্বরময় ও ব্রহ্মময়, সুতরাং তিনি নিত্য এক ও তিনি নিত্যবর্তমান। সবার মধ্যেই তিনি এবং তাঁর মধ্যেই সব। এককথায় তিনিই সব। তাঁর মধ্যে তদতিরিক্ত আর কেউ নেই। ইহাই হল চরম ও পরম সত্য। এই গুরুই হলেন সচ্চিদানন্দ স্বয়ং। তিনি স্বয়ংপূর্ণ স্বয়ংপ্রকাশ নির্গুণ সগুণ ও নির্গুণ-গুণী স্বয়ং। তিনি নির্গুণ গুণময়, নিত্যলীলাময়।[read more=”Read More…” less=”Read less”] তিনি নিজের মধ্যে নিজেকে স্বভাবে বহু কল্পনা করে বৈচিত্র্যরূপে নিজেকে প্রকাশ করেন। বৈচিত্র্যের মধ্যে নিজে অবস্থান করে নিজেই তা আস্বাদন করেন; আবার সবই নিজের মধ্যে গুটিয়ে নেন। এই লীলা হল তাঁর ভান বা স্বপ্নবিলাস ।”
“তিনি ব্যক্ত হয়েও অব্যক্ত এবং অব্যক্ত হয়েও ব্যক্ত। তিনি অদ্বৈত হয়েও দ্বৈত ও বহু হয়েও স্বয়ং অদ্বৈত। তিনি নিজেই দাতা নিজে গ্রহীতা। জ্ঞাতা, জ্ঞেয়, জ্ঞান স্বয়ং নিজেই। জ্ঞান, জ্ঞেয় ও জ্ঞানগম্য স্বয়ং নিজেই। বক্তা, শ্রোতা স্বয়ং নিজেই; দ্রষ্টা, দৃশ্য স্বয়ং নিজেই। অখণ্ড পূর্ণ নিত্য অদ্বৈতস্বরূপ দ্বৈতবিলাসেই হল তাঁর লীলা। এই লিলায় প্রতিপক্ষ সেজে তিনি স্বমহিমা কোথাও স্ববিরুদ্ধভাবের মাধ্যমে, কোথাও বিজাতীয় ভাবের মাধ্যমে, কোথাও স্ব-জাতীয় ভাবের মাধ্যমে, আবার কোথাও স্বগতভেদের ভাবের মাধ্যমে ব্যক্ত করে তা নিজে অনুভব করেন, আবার স্বেচ্ছায় তা নিজের মধ্যেই মিলিয়ে নেন, ইহাই হল তাঁর আত্মলীলাবিলাস…।”[/read]

Capture

গুরুর প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে আর একদিন তিনি বলেন –

“গাড়িতে যন্ত্রপাতি ইঞ্জিন থাকা সত্ত্বেও গাড়ি নিজে চলতে পারে না; চালকের প্রয়োজন হয়। তার মধ্যে পরিচালক শক্তি (leading energy, i.e. spiritual guide) হল গুরুমূর্তি। তিনি বাইরে থেকে প্রেরণা দেন, প্রয়োজনীয় উপাদান যোগণ, আবার ভিতরে বসে তিনিই set করে দেন। একেরই দ্বিবিধ প্রকাশ ও ব্যবহার ‘নরাকার দেহে তিনি নিরাকার স্বয়ং’।”

Capture

গুরুর প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে আর একদিন তিনি বলেন –

তিনি বলেন, “এই গুরুমূর্তি হল নৈর্ব্যক্তিক ( Impersonal form); কিন্তু এই গুরুই আবার স্থূলরূপ নিয়ে এসে মানুষকে তার ভিতরের ঈশ্বরীয় গুনগুলি বাড়াতে সাহায্য করেন। তিনি শিষ্যের মধ্যে শুধু ভাবের দ্বারা শুদ্ধ ভাবের সমন্ময় সাধন করেন। তারপর শুদ্ধ ও দিব্যবোধের বিকাশ সাধন করে অখণ্ড বোধসত্তার বক্ষে মিলিয়ে নেন।”

Capture

গুরুগীতা –

গুরু ঈশ্বর, ঈশ্বর গুরু, সুতরাং তিনি সর্বাধিষ্ঠান বিশ্বাধার সমগ্র জীবজগতের আব্রহ্মস্তম্ব সর্বচরাচার বিশ্বে প্রভু বিভু অন্তর্যামী নিয়ন্তা, তিনি গতি ভর্তা প্রভু সাক্ষী নিবাস শরণ সুহৃদ, তিনি নির্গুণ-গুণী, তিনি আত্মজ্ঞান পূর্ণতা মুক্তি এবং পরমানন্দদাতা, তিনি সমগ্র দ্বৈত প্রপঞ্চ ও বৈচিত্র্যের অতীত, রূপাতীত হয়েও দিব্য প্রেমের আতিশয্যে স্বভক্তের উদ্ধারে নিমিত্ত শরীররূপ ধারণ করেন, তিনি অদ্বয় নিত্য শুদ্ধ মুক্ত সর্বজীবে সর্বধী সাক্ষী, তিনি গুণাতীত ভাবাতীত দ্বন্দ্বাতীত নিত্য পূর্ণ ‘পরমে পরম আপনে আপন স্বয়ং-এ স্বয়ং’।

Capture

গুরুগীতা –

“পরমাত্মা পরব্রহ্মের বিমূর্ত রূপ যে সদ্‌গুরু তিনি নিত্য শুদ্ধ বুদ্ধ মুক্ত অজর অমর অপাপবিদ্ধ, তিনি ইন্দ্রিয়াতীত নিষ্কল নির্মল নিরঞ্জন অরূপ স্বরূপ সদাজাগ্রত সর্বজ্ঞ আনন্দস্বরূপ। বিশ্বাতীত হয়েও বিশ্বরূপে তিনিই স্বয়ং, ব্রহ্মা-বিষ্ণু-শিব তাঁরাই বিগ্রহ, তিনি পরমেশ্বর সর্ব দেবদেবীর অধিষ্ঠান, সর্ব জীবজগতের তিনিই প্রভু নিয়ন্তা। সুতরাং গুরু ভিন্ন ঈশ্বর নেই, ঈশ্বর ভিন্ন গুরু নেই, ঈশ্বরই আত্মা আত্মাই ঈশ্বর, গুরুই ঈশ্বর-আত্মা ঈশ্বর-আত্মাই গুরু স্বয়ং। অতএব গুরুর অধিক কোন তত্ত্ব ও দেবতা, সত্য ও জ্ঞান নেই। এই গুরু সবারই আপনস্বরূপ শুধু, আপন প্রিয়জন হতেও প্রিয়তমোত্তম, তাঁকে নমস্কার।”

Capture

গুরুগীতা –

সমগ্র বেদশাস্ত্রের সারাৎসার ব্রহ্ম-আত্মস্বরূপ গুরু স্বয়ং। কেবলমাত্র দৃষ্টি দ্বারাই সমগ্র জগৎকে তিনিই সৃষ্টি করে সকলকে পালন করেন। তিনিই সবার স্রষ্টা পাতা ও নিয়ন্তা। জগৎরূপ বৃক্ষে আরূঢ় নরকসাগরে নিমগ্ন জীবাত্মাদের একমাত্র ত্রাতা ও উদ্ধারকর্তা সদ্‌গুরু স্বয়ং। সদ্‌গুরুই হলেন সদাশিব, তিনি কারণাতীত কারণ, আদি কারণ। তিনি সংসারসাগর উত্তীর্ণ হবার সেতু বা তরণীস্বরূপ এবং তিনি সর্ব জ্ঞানের উৎস ও পূর্ণ জ্ঞানস্বরূপ। আত্মজ্ঞানের জ্যোতিতে তিনি শরণাগত সৎ নিষ্ঠ ভক্ত আশ্রিতদের তৃতীয় নয়ন, তথা জ্ঞাননয়ন, খুলে দেন; তার ফলে অজ্ঞান দ্বারা অন্ধ জীবের জীবত্ব অবসান হয়, সত্য পূর্ণতা মুক্তি ও শান্তিতে পুনঃপ্রতিষ্ঠা হয়।

Capture

সদ্‌গুরু মহিমা-

সদ্‌গুরুই কারণাতীত কারণ ও পরম কারণ এবং সর্ব কারণের প্রভব প্রলয়স্থান। তাঁর সত্তায়ই জগৎ সত্তাবান, তাঁর জ্যোতিতেই জগৎ প্রকাশমান। তাঁর আনন্দই জীবকে আনন্দময় করে, তাঁর অস্তিত্বেই জগৎ সত্য, তাঁর প্রভায় চন্দ্র-সূর্য-নক্ষত্র-অগ্নি প্রভৃতি হয় প্রভাময়।

Capture

সদ্‌গুরু মহিমা-

কেবলমাত্র সদ্‌গুরু স্মরণ এবং মনন দ্বারা সাধক অখণ্ড জ্ঞান লাভ করতে পারে। অতএব সদ্‌গুরুকে প্রণাম। তৎপ্রাপ্তিতে সর্বপ্রাপ্তি। সাধকের জন্মজন্মান্তরের সঞ্চিত কর্মসংস্কারকে শ্রীগুরু তাঁর আত্মজ্ঞানের শক্তি দ্বারা দগ্ধ করে দেন। গুরু নিত্য আরাধ্য, তাঁকে প্রণাম করে, তাঁকে স্মরণ করে সর্ব কাজ করলে তা সিদ্ধ হয়। তিনি আনন্দঘন মূর্তি। তিনি জ্ঞান, সুখ, শান্তিদাতা। তাঁর মুখাবয়ব আনন্দ ও শান্তির জ্যোতিতে উদ্ভাসিত। তাঁর ভক্তের কাছে তাঁর স্বরূপ হল জ্ঞানান্দ। আপন সত্য স্বরূপ সম্বন্ধে তিনি সদা সচেতন।[read more=”Read More…” less=”Read less”] তিনি ভবরোগের চিকিৎসক এবং যোগীদেরও আরাধ্য দেবতা। গুরু সৃষ্টি, স্থিতি, সংহার, অনুগ্রহ, নিগ্রহ এই পঞ্চবিধ জাগতিক বিধানের স্রষ্টা। তিনি ভক্তের মনকে শুদ্ধ করে অদ্বয় বরহ্মাত্মজ্ঞান দ্বারা তাঁকে উদ্বুদ্ধ করে দেন। গুরুমূর্তিই সমস্ত ধ্যানের মূল। গুরুর পাদপদ্মই সমস্ত পূজার মূল, গুরুর বাক্যই সমস্ত মন্ত্রের মূল, গুরুর কৃপাই সমস্ত মোক্ষের কারণ। জ্ঞান ব্যতীত শুধু গুরুভক্তি দ্বারাই গুরুপদ লাভ করা যায়। অতএব গুরু ব্যতীত শ্রেষ্ঠ বস্তু আর নেই। শ্রুতি ‘ইহা নয়, ইহা নয়’ এইরূপ প্রপঞ্চ নিষেধপূর্বক যে তত্ত্ব প্রতিপাদন করেছে, সমস্ত নিষেধের অবধিস্বরূপ সেই গুরুকে কায়মনোবাক্যে আরাধনা করা উচিত। কেবলমাত্র গুরুসেবা লব্ধ গুরুকৃপা প্রসাদে ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং শিব সৃষ্টাদি কার্য করতে সমর্থ হয়েছেন।[/read]

Capture

সদ্‌গুরু মহিমা-

গুরুসেবা অতীব দুর্লভ বস্তু। গুরুতত্ত্ব ত্রিলোকদুর্লভ। গুরুবিহীন ভ্রান্তচিত্ত জীবনের বেদাদি শাস্ত্রপাঠ শৈব শাক্তাদি আগমুক্ত সাধন পদ্ধতি এবং অন্যান্য কর্ম ও মতবাদ সবই নিষ্ফল। গুরুপ্রসাদ লাভার্থে বেদ পুরাণাদি শাস্ত্র অধ্যয়ন এবং সর্বকার্য সুসিদ্ধ হয়। যিনি গুরুদেবের পাদসেবা দ্বারা আত্মাকে সর্বপাপমুক্ত করে বিশুদ্ধ হয়েছেন তিনি সর্ব তীর্থস্নানের ফললাভে ধন্য ও কৃতার্থ। যে স্থানে গুরু বাস করেন তাই কাশীক্ষেত্রস্বরূপ। গুরুর পাদোদক গঙ্গোদকস্বরূপ এবং গুরুই সাক্ষাৎ বিশ্বেশ্বর শক্তি। সুতরাং গুরুকেই তারকব্রহ্ম বলে জানবে। তিনি তীর্থরাজ প্রয়াগস্বরূপ। এতাদৃশ গুরুমূর্তিকে পুনঃপুনঃ প্রণাম।

Capture

শিষ্যের কর্তব্য-

সর্বদা গুরুমূর্তিকে স্মরণ এবং গুরুনাম জপ করবে। সর্বদা গুরুর আজ্ঞা হৃষ্টচিত্তে যথাযথভাবে পালন করবে এবং গুরু ব্যতীত অন্য বস্তুর ভাবনা করবে না। ব্রহ্ম গুরুমুখেই অবস্থিত। কেবল তাঁর প্রসাদেই তা লাভ করা যায়। অতএব স্বাশ্রম বিহিত অনুষ্ঠান, স্বজাতিগত কর্ম এবং পুষ্টিবর্দ্ধিনী কীর্তি ও অন্যান্য লৌকিক বিষয় পরিত্যাগ করে কেবল গুরুচিন্তা করবে, অন্য বস্তুর ভাবনা করবে না। গুরুবিদ্যার সাধনা প্রাথমিক স্তরে কর্মসাপেক্ষ হলেও মধ্যম স্তরে তা কর্মনিরপেক্ষ, জ্ঞানসাপেক্ষ, অর্থাৎ জ্ঞানপ্রধান। পরিণামে জ্ঞানস্থিতি লাভের পর পুনরায় তা কর্মের সঙ্গে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবেই অভিব্যক্ত হতে পারে। তখন কর্ম স্বতঃস্ফূর্ত কর্ম। জ্ঞান স্বতঃসিদ্ধ ও স্বতঃস্ফূর্ত জ্ঞান। জ্ঞান ও কর্মের মধ্যে তখন দ্বন্দ্ব বা বিরোধ আর থাকে না। ইহাই হল তত্ত্বভূমির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ইহা জ্ঞানবাদ নয়, জ্ঞানতত্ত্বের অনির্বচনীয় মহিমা।

Capture

শিষ্যের কর্তব্য-

ব্রহ্মবিদ্যা আত্মবিদ্যা গুরুমুখে অবস্থিত এবং একমাত্র গুরুভক্তি দ্বারাই তা লাভ করা যায়। অতএব অতি যত্নসহকারে গুরুর আরাধনা করবে। গুরুমন্ত্র সর্বশাস্ত্রের সার, মন্ত্ররাজ। ইহা ব্রহ্মাত্মপদে সাধককে সুপ্রতিষ্ঠিত করে দেয়। সাধনকালে জ্ঞান, ভক্তি, কর্ম ও যোগের মধ্যে পারস্পরিক ভেদ দৃষ্টি হলেও পূর্ণসিদ্ধির স্তরে সেসবই পরমতত্ত্বের স্ফূর্তিরূপে সমরসাত্মক বা একরসাত্মক বিজ্ঞানের অভিন্ন প্রকাশধারা মাত্র।

Capture

শিষ্যের কর্তব্য-

সদ্‌গুরু পুনঃপুনঃ নমস্কার করার বিজ্ঞানসম্মত তাৎপর্য হল জীবনের প্রতি পদে আশ্রিত ভক্তশিষ্যের মঙ্গল ও কল্যাণের নিমিত্ত তাঁর যে অভিনব অনলস দিব্যদৃষ্টি ও প্রচেষ্টা তার তুলনা নেই। তিনি তাঁর স্বানুভবসিদ্ধ স্বভাব দ্বারা ভক্তকে আত্মজ্ঞান প্রদান করে বহু জন্মার্জিত কর্মবন্ধন ছিন্ন করে দেন। তাঁর পাদোদক ভবসাগর শোষণ করে সার সম্পদকে বিজ্ঞাপন করে দেয়। যে গুরুদেব অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ তত্ত্ব আর নেই, যাঁর আরাধনা অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ আরাধনা আর নেই, যাঁর তত্ত্বজ্ঞান অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ বস্তু আর কিছুই নেই, সেই গুরুদেব হলেন শ্রেষ্ঠ আরাধ্য দেবতা। তিনি সবারই নমস্য।

Capture

গুরুপূজার তাৎপর্য –

গুরুমূর্তিই সমস্ত ধ্যানের মূল। গুরু পাদপদ্ম পূজাই সমস্ত পূজার মূল। গুরুবাক্যই সর্ব মন্ত্রের মূল এবং গুরুকৃপাই মোক্ষের কারণ। সপ্তসাগর পর্যন্ত তীর্থাদিতে স্নানের যে ফললাভ হয় তা দুর্লভ, কিন্তু তদপেক্ষা সহস্রাংশে দুর্লভ হল গুরুদেবের পাদোদক। গুরুদেবই স্বয়ং সর্ব দেবদেবীময়। তিনি ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব এবং সমস্ত জগৎ-এইরূপ সর্বাত্মক গুরু অপেক্ষা আর শ্রেষ্ঠ বস্তু নেই। অতএব সেই গুরুদেবের সম্যক্‌রূপে পূজা সর্বোত্তম কর্তব্য। জ্ঞানের অধিকারী সবাই হতে পারে না; ভক্তির অধিকারী সবাই হতে পারে। কেবলমাত্র গুরুভক্তি দ্বারাই মুক্তিপদ লাভ করা যায়। গুরুভক্তগণ এতাদৃশ গুরুকে ধ্যান করেন, ভজন করেন। গুরুধ্যান ও ভজনের মাধ্যমে স্ব-তত্ত্বে প্রতিষ্ঠা অর্থাৎ আত্মবোধে সুপ্রতিষ্ঠা হয়।

Capture

গুরুর নির্গুণ স্বরূপের প্রণাম –

সর্বপ্রকার আনন্দদায়ক, সর্বসুখকর, নিত্য ভোগ ও মুক্তির ফলপ্রদানকারী গুরুদেবের ধ্যানই হল শ্রেষ্ঠ। আমি শ্রীমৎপরমব্রহ্ম গুরুপদ উচ্চারণ করি, শ্রীমৎপরমব্রহ্ম গুরুদেবকে ভজনা করি, শ্রীমৎপরমব্রহ্ম গুরুদেবকে স্মরণ করি এবং শ্রীমৎপরমব্রহ্ম গুরুকে প্রণিপাত করি। যে গুরুদেব ব্রহ্মানন্দ, পরম সুখদাতা, এক, অদ্বিতীয়, দ্বন্দ্ব-রহিত, তত্ত্বমসি বাক্যের লক্ষণ, এক, নিত্য, বিমল, অচল, সর্ববুদ্ধিবৃত্তির সাক্ষীরূপে বিদ্যমান, সর্বপ্রকার ভাবনার এবং ত্রিগুনের অতীত সেই সদ্‌গুরুকে প্রণিপাত করি। যিনি নিত্য শুদ্ধ স্বয়ংপ্রকাশ নিরাকার নিরঞ্জন নিত্যবোধস্বরূপ চিদানন্দ এবং ব্রহ্মস্বরূপ, সেই গুরুদেবকে নমস্কার করি এবং নিরন্তর ধ্যান করি। যিনি স্বয়ং আনন্দময় ও আনন্দবর্দ্ধনকারী মঙ্গলময়, যিনি জ্ঞানস্বরূপ এবং স্বয়ংবোধ, যিনি যোগিগণের পূজ্য, সেই গুরুদেবকে নিত্য ভজনা করি।

Capture

সগুণ ও নির্গুণ ভেদে গুরুধ্যানের বিধান –

যিনি চিৎপদ্মে কণিকামধ্যে সিংহাসনোপরি দিব্যমূর্তিরূপে সংস্থিত, চন্দ্রলেখা ভূষণে ভূষিত এবং যিনি সচ্চিদানন্দ ও অভীষ্ট বরপ্রদ, সেই গুরুদেবকে ধ্যান করবে।যিনি শ্বেতাম্বর শ্বেতবিলেপনযুক্ত মুক্তামালায় ভূষিত দিব্যমূর্তি এবং যাঁর বামাঙ্গে দিব্যশক্তি বিরাজমান, যিনি ঈষৎ হাস্যযুক্ত পূর্ণ কৃপার আধার তাঁর সাধনা দ্বারা সাধক কৃতকৃত্য। প্রাতঃকালে শিরঃস্থিত শ্বেতপদ্মে ত্রিনেত্র, দ্বিবাহু বর এবং অভয়হস্ত, প্রশান্ত গুরুদেবকে তাঁর নাম উচ্চারণপূর্বক স্মরণ করবে। এই প্রকার গুরুধ্যান করতে করতে যখন জ্ঞানোৎপত্তি হয়, তখন ‘আমি মুক্ত হলাম’ এই প্রকার ভাবনা করবে। গুরুদর্শিত মার্গে ভ্রমন করে চিত্তশুদ্ধ করবে এবং আত্মগোচর নিখিল অনিত্য দ্রব্যের খণ্ডন করবে। জ্ঞেয় বস্তুমাত্রই অনিত্য এবং জ্ঞানই মন, সুতরাং জ্ঞান এবং মন উভয়ই সমান। অতএব আত্মা ব্যতীত অন্য বস্তুর আর নিত্যতা নেই। গুরুনিন্দা শ্রবণ করা পাপ, নিজে তা বলাও পাপ। গুরুনিন্দুকের নরকবাস হয় অনন্তকাল। মুনি সর্প এবং দেবগণ কর্তৃক অভিশপ্ত হলেও গুরদেব তাকে রক্ষা করেন। তিনি মৃত্যুভয় হতেও তাকে রক্ষা করেন। কিন্তু গুরুদে অভিশাপ প্রদান করলে সেই ব্যক্তি ক্ষীণ হয়ে বিনাশপ্রাপ্ত হয়। তাকে দেবগণ এবং মুনিগণও রক্ষা করতে সমর্থ হন না।

Capture

সদ্‌গুরু পরিচয় –

সমগ্র আধ্যাত্মবিদ্যা হল গুরুগত বিদ্যা। সদ্‌গুরু কৃপায় এই বিদ্যালাভ হয়। এই বিদ্যাকেই পরাবিদ্যা বলে। পরাবিদ্যাই হল পরমতত্ত্ব লাভের বিজ্ঞান। পরমতত্ত্বই হল ব্রহ্মতত্ত্ব, আত্মতত্ত্ব, ঈশ্বরতও্ব ও গুরুতত্ত্ব। ইহা হল অখণ্ড একবোধ, সমবোধ বা আপনবোধের বিজ্ঞান। প্রজ্ঞানের বিজ্ঞান এবং বিজ্ঞানের প্রজ্ঞানই হল পরমতত্ত্ব। অভেদ জ্ঞান বা নিত্যাদ্বৈত জ্ঞান হল পরমতত্ত্ব ও অমৃতত্ব …।

Capture

গুরুর বৈশিষ্ট্য ও তাঁর মহিমা –

গুরু হলেন সত্য-জ্ঞান-আনন্দ ও প্রেমের জীবন্ত বিগ্রহ। সদ্‌গুরুর স্থূল মূর্তি বা রূপই হল পূজা বা উপাসনার শ্রেষ্ঠ অবলম্বন। তাঁর বাক্য ও নামই হল শ্রেষ্ঠ মন্ত্র। ইহাকে ভজন করাই হল শ্রেষ্ঠ জপ। গুরুভাবই হল শ্রেষ্ঠ ধ্যেয় বস্তু। গুরুবোধ হল পূর্ণ উপলব্ধি। সদ্‌গুরু স্বয়ং সর্ব দেবদেবীর অধিষ্ঠান এবং ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বরের একক মূর্তি। তিনিই আবার পরমব্রহ্ম পরমাত্মা স্বয়ং। সকলেই তাঁর আশ্রিত। গুরুতত্ত্বই সর্বতত্ত্বসার। গুরুতত্ত্ব সমগ্র শক্তি ও সত্তার পূর্ণস্বরূপ। সর্ব জীবনের মূল বা উৎসই হল শ্রীগুরু স্বয়ং। সাধনার ক্রমপর্যায়ে গুরুর রূপ-নাম-ভাব- বোধের সঙ্গে সাধকের তাদাত্ম্য লাভ হয়। গুরুর দেহকে নিজের দেহের মধ্যে এবং নিজের দেহকে গুরুর দেহের মধ্যে পুনঃপুনঃ ভাবনা করতে হয়।[read more=”Read More…” less=”Read less”] গুরুর প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে নিজের প্রতিটি প্রাণের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মধ্যে চিন্ত বা ন্যাস করতে হয়। ইহাই হল শ্রেষ্ঠ অঙ্গন্যাস। গুরুর কথা ও নামকে প্রতিটি প্রাণের বৃত্তির মধ্যে ন্যাস করতে হয় বা চিন্তা করতে হয়। গুরুর ভাবকে মনের প্রতি বৃত্তি বা চিন্তার সঙ্গে যুক্ত করে ধ্যান করতে হয়। তাহলে সহজেই গুরুভাবে সমগ্র অন্তর ও বহিঃসত্তা পূর্ণ হয়। তখন নিজের পৃথক বোধ আর থাকে না। এইভাবে সাধনা করলে সহজেই গুরুবোধের সঙ্গে তাদাত্ম্য লাভ হয়…।[/read]

Capture

‘গুরু’ শব্দের তাৎপর্য –

গুরু হলেন অজ্ঞান বিনাশক, জ্ঞানদাতা ও মুক্তিদাতা। সংকীর্ণতা হল অজ্ঞানতা। অজ্ঞানতা হল মৃত্যু। দ্বৈত ভাব হতে দ্বন্দ্ব ও সংশয় হয়। ইহা অবিদ্যা ও অজ্ঞানতার অন্তর্ভুক্ত। বিরুদ্ধতাই হল দুঃখ। মোহ অন্ধকারই হল নরকতুল্য। বিশুদ্ধ জ্ঞান হল অমৃতস্বরূপ। বিশুদ্ধ জ্ঞানকেই তত্ত্ব বলে। তত্ত্বের অধিকারী হলেন সদ্‌গুরু। গুরুই সর্বনিয়ন্তা, সর্ববিধাতা ও একাদশ ইন্দ্রিয়ের অধিকর্তা। তিনি অনন্ত অসীম নিত্য শুদ্ধ বুদ্ধ মুক্ত এবং সত্য-জ্ঞান-আনন্দ ও প্রেমস্বরূপ, অদ্বয়, অব্যয়, অমৃতময়, মুক্তি ও শান্তির আশ্রয়। গুরু অন্তরে গুরুবোধ জাগিয়ে লঘুত্বের বেড়া সরিয়ে দেন। ‘গুরু’ শব্দের মমার্থ হল গুণাতীত, রূপাতীত বোধস্বরূপ আত্মা। সর্ববোধাত্মা, পরবোধাত্মা ব্রহ্মদেবই হলেন সদ্‌গুরু স্বয়ং সবার আপন প্রিয়তমোত্তম ও পরমপ্রেমাস্পদ।

Capture

প্রকৃতির সর্বস্তরে জ্ঞানরূপী গুরুই কেবল বিদ্যমান, তিনিই ব্রহ্ম-আত্মা –

“গুরু কেবলং জ্ঞানমূর্তিম্‌”। অতীত ও বর্তমানকে এই জ্ঞান ধরে রেখেছে। শিক্ষা-দিক্ষা এই জ্ঞানরূপী গুরুরই বিবিধ ব্যবহার। গুরুর সঙ্গে প্রত্যেকেরই যোগ আছে। শিক্ষাগুরু সবারই আছে। বিশ্বের কাছ থেকে প্রতিনিয়ত প্রত্যেকেই পায় শিক্ষা। চারিদিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায় যে সমগ্র বহিঃপ্রকৃতি অর্থাৎ আকাশ, বাতাস, তেজ, জল, পৃথিবী এবং গ্রহনক্ষত্রাদি সকলের কাছ থেকেই জীব শিক্ষা ও উপকার পায়। সকলের পুষ্টি, তুষ্টি ও পূর্ণতার জন্য প্রয়োজনীয় উপকার যার মাধ্যমে পাওয়া যায় তাকেই মহৎ ও গুরু বলা হয়। মহান্‌ গুরুর কাজ হল অপরকে মহান ও পূর্ণ করা। প্রথমে শিক্ষার মাধ্যমে ও পরে দীক্ষার মাধ্যমে তিনি পূর্ণতা বিধান করেন।[read more=”Read More…” less=”Read less”]প্রকৃতির অন্তর্নিহিত সত্তার প্রতি যথার্থ মর্যাদাবোধ জাগ্রত করার জন্য লোকগুরু ও সদ্‌গুরুগণই মানুষকে যথার্থভাবে সাহায্য করেন। গুরুর সাহায্য ব্যতীত শিক্ষা ও জ্ঞান লাভ হয় না। সকলে যার মধ্যে বাস করে, যা দিয়ে জীবনধারণ করে, যাতে পুষ্ট ও তুষ্ট হয়, এককথায় যার দ্বারা পূর্ণতা লাভ হয় তা-ই গুরুমূর্তি এবং তা-ই গর্বের বস্তু, পরম আদরের বস্তু, পরম প্রীতিকর, প্রিয় ও আনন্দময়। এই জন্য মাতাপিতাকে মহাগুরু বলা হয়।
গুরুকে প্রাকৃতবোধে না নিয়ে দেববোধে মানতে হয়। তাহলেই অন্তরে গুরুভাব ও গুরুবোধ সহজে জাগ্রত হয়। না মানলে কোন বিষয় গর্ব করা যায় না। মানার অভাবে জ্ঞানের অভাব থাকে। জ্ঞানের অভাবে গুরুবোধের উপলব্ধি হয় না।
গুরুবোধ জাগলেই মানুষ শ্রদ্ধাবান হয় এবং শ্রদ্ধাবানেরই গুরুবোধ জাগে। গুরুই যে একমাত্র রক্ষাকর্তা এই বিশ্বাস শ্রদ্ধার উপরেই নির্ভর করে। শ্রদ্ধা হল সত্যময়। সত্যবোধ জানাজানি বোঝাবুঝি প্রভৃতি অভিমানের উপর নির্ভর করে না। সত্যধারণের যোগ্যতাই মানুষকে গুরুসঙ্গ করিয়ে দেয়। শ্রদ্ধারই বিশেষ রূপ হল বিশ্বাস।[/read]

Capture

চতুর্বিধ বোধের স্তর –

১)শক্তিস্বরূপ ২) জ্ঞানস্বরূপ ৩) আনন্দস্বরূপ ৪) প্রেমস্বরূপ । এই চতুর্বিধ ঈশ্বরীয় অভিব্যক্তির মধ্যে প্রেমের স্বরূপই হল শ্রেষ্ঠ। পূর্ণপ্রেমে শক্তি, জ্ঞান ও আনন্দ পূর্ণভাবে বিদ্যমান থাকে। সেইজন্য প্রেম স্বভাবসিদ্ধ, নিরপেক্ষ, একক সত্যের সত্তা ও শক্তি স্বয়ং।

Capture

চতুর্বিধ বোধের স্তর –

গুরু হলেন স্নেহময়। তিনি প্রজ্ঞানঘন, পূর্ণ আনন্দময়, প্রেমময় ও রসময়। মায়ের সঙ্গে তাঁর স্বভাবের সাদৃশ্য স্বীকৃত। তিনি নৈর্ব্যক্তিক ও ব্যক্তি উভয়ই; অর্থাৎ নির্গুণ-সগুণ ও নিরকার-সাকার উভয়ই তাঁর পরিচয়। তিনি আবার নির্গুণ-গুণীও বটে। নিষ্ক্রিয় অবস্থায় তাঁকেই পুরুষ বলা হয় এবং সক্রিয় অবস্থায় তাঁকে শক্তি ও প্রকৃতি বলা হয়। তিনি হলেন সকলের প্রাণের প্রাণ অতি আপন। ‘আপনবোধে’ তাঁর অনুভূতি মেলে।

Capture

চতুর্বিধ বোধের স্তর –

ব্রহ্মগুরুর মহিমা ব্রহ্মগুরু স্বয়ং যুগের প্রয়োজনে নূতন নূতন ভঙ্গিমায় প্রকাশ করেন। সমগ্র সৃষ্টি হল ব্রহ্মের অণু ও পরমাণুর খেলা। অণোরণীয়ান হল ব্রহ্মের পরমাণু রূপ এবং মহতোমহীয়ান হল ব্রহ্মের অখণ্ড রূপ। চিন্ময়ী মা অণুকে অর্থাৎ তাঁর সন্তানকে অজ্ঞাত ও অনাস্বাদিত সেই চরমতম অবস্থায় পৌঁছে দেন।

Capture

গুরুর পরিচয় –

সত্তা ও শক্তি অভেদ। সত্তার বক্ষেই শক্তি বিরাজ করে এবং শক্তির বক্ষেই সত্তা বিরাজ করে। কৃষ্ণ হল কর্ষণশক্তি, আনন্দশক্তি ও কেন্দ্রশক্তির সত্তা। ধারা হল লয়শক্তি, আরাধনাশক্তি ও হ্লাদিনীশক্তি।
যে আনন্দঘন চৈতন্য প্রাণকে ধাক্কা দিয়ে সংকুচিত অবস্থার থেকে প্রসারিত করে দেয় তাকেই গুরু বলে। ছোট নদী সমুদ্রের আকর্ষণে সমুদ্রের দিকেই ছোটে। সমুদ্রের আকর্ষণশক্তিই নদীকে টেনে নিয়ে যায়। সেইরূপ কেন্দ্রসত্তার আকর্ষণশক্তি গুরুশক্তিরূপে প্রত্যেককে কেন্দ্রের দিকে টেনে নিয়ে যায়। গুরুর কাজ হল লঘুকে গুরু বানানো।[read more=”Read More…” less=”Read less”]স্থূলে ও সূক্ষ্মে সর্বত্রই গুরু সমভাবে বিদ্যমান। সেই বোধের দৃশটিতে অধিভূত, অধিদৈব, অধ্যাত্ম ও অধিযজ্ঞ সবই গুরুমূর্তি। অধিভূতরূপে গুরুর কাজ হল পঞ্চভৌতিক বাহ্য। অধিদৈবরূপে গুরুর কাজ হল নৈসর্গিক ও ইন্দ্রিয়াত্মক। অধ্যাত্মরূপী গুরুর কাজ আভ্যন্তরীণ বিজ্ঞানাত্মক এবং অধিযজ্ঞরূপে গুরুর কাজ হল প্রজ্ঞানাত্মস্বরূপে সাক্ষী ও দ্রষ্টাবোধে স্থিতি। প্রজ্ঞানগুরুই হলেন পরমাত্মা প্ররব্রহ্ম সনাতন। এই গুরুই নিত্যাদ্বৈত নির্গুণ-গুণী। সকলের অন্তরে বাইরে সর্বত্র নিত্য এক গুরুই আছেন।[/read]

Capture

ঋণস্বীকার দ্বারা কৃতজ্ঞতাবোধ প্রকাশ –

গুরুর ঋণ শোধ করা যায় না। শুধু পূর্ণ আত্মসমর্পণের মাধ্যমে তাঁর সঙ্গে মিশে যাওয়া যায়। সন্তান বা শিষ্যের প্রথম অবস্থা হল লঘু। গুরুর সান্নিধ্যে, গুরুসঙ্গ দ্বারা, গুরুর নির্দেশ, আদেশ ও আজ্ঞা পালন করে লঘু শিষ্যে বা সন্তান গুরুবোধ গ্রহণ করে। ‘মানা’-র মাধ্যমেই লঘু গুরুবোধে পরিণত হয়। ইহাই হল গুরুর সঙ্গে পূর্ণ মিলন-তন্নিষ্ঠ তৎপরায়ণ তদ্‌গত তন্ময় তাদাত্ম্য মাধ্যমে তৎস্বরূপ প্রাপ্ত হয়ে গুরুময় হয়ে যাওয়া অর্থাৎ বোধে বোধময় হয়ে যাওয়া।

Capture

‘দক্ষিণা’ শব্দের তাৎপর্য –

আত্মদান, সেবা ও মানার মাধ্যমেই হয় মহতের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন।

Capture

সচ্চিদানন্দময়ী মা স্বয়ং গুরুরূপে আবির্ভূত হন, মাতৃতত্ত্ব ও গুরুতত্ত্ব অভিন্ন ।

Capture

সদ্‌গুরুর শিক্ষাপদ্ধতি –

সদ্‌গুরুদের জীবন হল পূর্ণ দীক্ষার জীবন অর্থাৎ আত্মদানের জীবন। তাঁরা ব্যষ্টি জীব সন্তানের সন্তানের অহংকাররূপ মলিনতা গ্রহণ করে আপনার শুদ্ধস্বরূপ দান করেন। আত্মজ্ঞান দানই হল পূর্ণ দীক্ষা দান। সদ্‌গুরুর কাছে আপন অহংকারকে সঁপে দিয়ে সদ্‌গুরুর দেওয়া আত্মজ্ঞান গ্রহণ করাই হল সত্যের দীক্ষা। স্ববোধে সব মানাই হল আত্মজ্ঞান লাভ করা ব সত্যদীক্ষার তাৎপর্য। ‘জানা হল জ্ঞান’ বং ‘মানা হল বিজ্ঞান’। জ্ঞান অজ্ঞানের সঙ্গে যুক্ত থাকে বলে মলিন ও অশুদ্ধ; সুতরাং অপূর্ণ। কিন্তু ‘মানারূপ বিজ্ঞান’ প্রজ্ঞানের সঙ্গে যুক্ত থাকে বলে নিষ্কল, নির্মল ও বিশুদ্ধ…।

Capture

অশুদ্ধ চিত্তের মল শোধন এবং মনোনাশের জন্য গুরুর একান্ত প্রয়োজন –

চিত্তের কামনা-বাসনারূপ ময়লা পরিষ্কার হলে আত্মার স্বরূপ অর্থাৎ বিশুদ্ধ বোধের স্বতঃস্ফূর্ত ধারা বা প্রকাশ অনুভূত হয়। বৃহত্তর বোধ অর্থাৎ গুরুর সাহায্য ছাড়া কেবলমাত্র ব্যক্তিগত চেষ্টা দ্বারা অন্তরের কামনা-বাসনারূপ ময়লা পরিশোধিত হয় না। উত্তম অধিকারী আত্মচেষ্টা দ্বারা আত্মজ্ঞান লাভ করে মুক্তি লাভ করে। মধ্যম অধিকারী গুরুকৃপায় গুরুশক্তির সাহায্যে সাধন-ভজন করে ও অশুদ্ধ চিত্ত শোধন করে ইষ্টের সঙ্গে যুক্ত হয়। সাধারণ অধিকারী ইষ্ট ও গুরুর কৃপার ওপর নির্ভর করে সাধনার পথে এগিয়ে চলে। গুরুকৃপায় অনুগত আশ্রিত সন্তান তাঁর কাছ হতে দৈবী সম্পদ লাভ করে। দৈবী সম্পদ হল সত্ত্বগুণ ও ঈশ্বরীয় ভাব।
ধোপার কাজের সঙ্গে সদ্‌গুরুর কাজের অনেকাংশ তুলনা চলে। গুরু যেন ধোপা, জীবপ্রকৃতি হল যেন পোশাক-পরিচ্ছদ, জীব হল বাবুমশায়। বীজমন্ত্র বা ইষ্টনাম হল সাবান-সোডা। জ্ঞানবিচার হল অগ্নি বা তাপ। নিত্যকর্ম বা সাধননিষ্ঠা (যোগ ধ্যান) হল ভাটি। শ্রদ্ধা হল পৈঠা। ভক্ত হল জল, বিশ্বাস হল কলপ, আনন্দ হল ইস্ত্রি এবং প্রেম হল স্বানুভূতি।

Capture

শিক্ষা ও দীক্ষার রহস্য –

ভগবৎ সত্তার অনুভূতির জন্য গুরু বা ইষ্টের শরণ নিতে হয়। ভক্তের সুবিধার জন্য ইষ্টই গুরুমূর্তিতে তার কাছে আসে। গুরুর প্রতি নিষ্ঠা হলে মুক্ত হওয়া যায়। ভিতর মহলে যিনি ইষ্ট, বাইরের মহলে তিনিই গুরু। গুরুই মানুষকে ইষ্টের কাছে পৌঁছে দেন। সেইজন্য গুরুবাদিগণ সবার উপরে গুরুকে স্থান দেন, তিনি যেমনই হন না কেন। …প্রত্যেকের নিজের ভিতরে গুরুকে দেখতে হয়। সেই গুরু কোন ব্যক্তিরূপ নয়। তিনি হচ্ছেন প্রত্যেকের সত্তা। এই গুরুই প্রত্যেকের ভিতরে বসে সকলের মধ্যে আত্মসমর্পণের ভাব জাগিয়ে দেন।
সদ্‌গুরু বা সত্যদ্রষ্টা পুরুষগণ ভগবানের মূর্ত বিগ্রহ। তাঁরা যা কিছু করেন বা বলেন সবই সত্য। তাঁদের কাছে গেলে আপনিই মাথা নত হয়, চিত্ত শান্ত হয়। মহাপুরুষগণ আসেন মানুষকে স্ব-স্বরূপের পরিচয় দিতে এবং অমৃতত্বের সংবাদ দিতে। সকলকে স্বভাবে প্রতিষ্ঠিত করে তাঁরা চলে যান। তাঁদের কাজ তখন শেষ হয়ে যায়। বিরাট মিষ্টান্নের থালায় পিঁপড়ে পড়ে গেলে তার যেমন অবস্থা হয়, আনন্দের রাজ্যে গিয়েও মানুষের ঠিক সেই রকম অবস্থা হয়। তখন তারা আর নিজেদের পৃথক আমিকে খুঁজে পায় না।

Capture

সদ্‌গুরুরা কীভাবে মনের ইচ্ছা পূরণ করেন ?

দেহেন্দ্রিয় মন সুসংযত করে একাগ্রচিত্তে ব্যাকুলভাবে তাঁর শরণ নিলে তিনি শরণাগত ভক্তের ইচ্চা পূরণ করেন। অসংযত ইন্দ্রিয়মনের মাধ্যমে চাওয়ার ত্রুটি থাকে। তার ফলে সদিচ্ছা অন্তরে জাগে না, জাগলেও তা স্থায়ী হয় না এবং গুরুকে স্মরণ করাও ঠিকমত হয় না অশান্তচিত্তে কোন কিছু প্রার্থনা করলে তা পূরণ হতে অধিক সময় লাগে। সদ্‌গুরু শুদ্ধ দেহেন্দ্রিয়-মনে অর্থাৎ শুদ্ধচিত্তে যেভাবে সহজে কাজ করেন, অশুদ্ধচিত্তে সেভাবে করেন না। সদ্‌গুরুর আশিস্‌, কৃপা ও করুণা পেতে হলে একান্তভাবে তাঁর অনুগত ও শরণাগত হতে হয়। সদ্‌গুরু সর্বজ্ঞ পুরুষ। তিনি দেশ-কাল, কার্য-কারণ ও ত্রিগুণা প্রকৃতির অতীত হয়েও আবার সর্বব্যাপী, সর্বধারী, নিত্য ও সর্বাশ্রয়ী। সর্বজীবের আন্তর সত্তায় সদ্‌গুরু সর্বচিন্তা ও কর্মের দ্রষ্টা ও সাক্ষীরূপে নিত্য বিদ্যমান।
সদ্‌গুরুর দেহ সৎ, কর্ম সৎ, বাক্য সৎ, চিন্তা ও বোধ সৎ ও নিত্য। সদ্‌গুরুর সঙ্গ পেলে সদ্‌গুরুর আশিস্‌, কৃপা ও করুণালাভের অধিকারী সহজে হওয়া যায়। তার ফলে অল্পকালের মধ্যে চিত্ত শুদ্ধ হয় এবং চিত্ত শুদ্ধ হলে সদ্‌গুরুর অনুকম্পা লাভ করা যায়। পূর্ণমাত্রায় অনুকম্পা লাভের দ্বারা গুরুতাদাত্ম্য অনুভূত হয়।

Capture

সদ্‌গুরু স্থূলদেহে কোন স্থানে অবস্থান করলেও একই সময় তাঁকে স্মরণ করে ভিন্ন ভিন্ন স্থানে অনেকে তাঁর দেখা পায় কেমন করে?

সদ্‌গুরু স্বয়ং ব্রহ্ম-আত্মা ঈশ্বর। তিনি সর্বজ্ঞ, সর্বভূতাশ্রয়ী এবং সকলের অধিষ্ঠানচৈতন্য। সুতরাং ইচ্ছামাত্র তিনি স্থানবিশেষ দেহ পরিগ্রহ করে প্রকটিত হতে পারেন শরণাগত ভক্তকে অনুগ্রহ করার জন্য।

Capture

আত্মসমর্পণের বিশেষ একটি পদ্ধতি –

আমার গুরু, আমার ঈশ্বর এবং আমার ইষ্ট বা আমার আত্মা না বলে এবং আমি গুরুর, ঈশ্বরের, ইষ্টের বা আত্মার না বলে গুরু, ইষ্ট প্রভৃতির আমি এবং তাঁরই সত্তা এবং শক্তি আমার মধ্যে এইরূপ ব্যবহার করলে সহজেই অন্তর শুদ্ধ হয় এবং আত্মসমর্পণ সম্পূর্ণ হয়। আত্মসমর্পণযোগে সাধককে সর্বপ্রকার জাগতিক আনন্দ ও দুঃখের চরমতম অবস্থার মধ্যেও অবিচলিত থাকতে হয়। সুখ-ঐশ্বর্য, মান-সম্মান-প্রতিপত্তিতেও তার চিত্ত বিচলিত হওয়া চলবে না এবং সম্পত্তিনাশ, চরমতম দৈন্য, দারিদ্র, অপমান, লাঞ্ছনা এমনকি অতি আপন প্রিয়জনের বিয়োগেও আবিচলিত থাকতে হবে। তাহলেই তার সর্ববিধ অনর্থ নিবৃত্তি হবে। তখন সে নিত্য সত্যস্থ ও নির্দ্বন্দ্ব অবস্থায় প্রতিষ্ঠিত হবে।
আমার ভগবান এবং আমার মা এইরূপ ব্যবহার না করে ভগবানের বা মায়ের আমি এইরূপ ব্যবহার দ্বারা মানার বিজ্ঞান বা সর্বসমর্পণের বিজ্ঞান ফলপ্রদ হয়। সমবোধ হল গুরুবোধ। গুরুবোধে মিশে গেলে ইষ্টলাভ হয়…।

Capture

ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বরের একক রূপ হল সদ্‌গুরু/সচ্চিদানন্দময়ী মা –

ঈশ্বর সকলের অন্তর্যামী বলে সকলের ভাষাই বোঝেন। পরমেশ্বরী মায়ের সন্তান সর্বজীবন। সকলেরই মনের কথা মা আগে জানেন। সেইরূপ সদ্‌গুরু সবার অন্তরাত্মা বলে সর্বভাব তিনিই প্রথম অবগত হন এবং পরে সবাই জানে। তাঁকে বাদ দিয়ে কোন জ্ঞান, চিন্তা, কর্ম সম্ভব নয়। সর্বপ্রকার জ্ঞান, চিন্তা ও কর্মের সাক্ষীরূপে ও দ্রষ্টারূপে তিনি নিত্য বর্তমান। তাঁকে ফাঁকি দেওয়া যায় না। সেইজন্য সচ্চিদানন্দ গুরু ও সচ্চিদানন্দ মা অভিন্ন। উভয়ে এক পরমাত্মার পরিচয়।
যিনি মা, তিনিই গুরু এবং তিনিই হর ও তিনিই হরি। জগতে পরমাত্মার তিনরূপ তিন দেবতা। ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর স্বয়ং সচ্চিদানন্দময়ী মাতা। আরাধ্য তিন দেবতা হল শিব, বিষ্ণু ও মা। তিনের ঘনিষ্ঠ একক মূর্তি হল সদ্‌গুরু স্বয়ং। গুরুপ্রীতিই হল সর্বসিদ্ধির মূল। গুরুপ্রীতি মানে ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মায়ের কৃপাশিস, করুণা, অনুকম্পা ও অনুগ্রহ।

Capture

সদ্‌গুরু স্বয়ং সর্বতত্ত্বময়, অর্থাৎ তিনি সর্বদেবময়, সর্বাত্মময়, সর্বেশ্বরময় এবং ব্রহ্মময়; সুতরাং তিনি নিত্য এক ও নিত্যবর্তমান। সবার মধ্যেই তিনি এবং তাঁর মধ্যেই সব। এক কথায় তিনিই সব। তাঁর মধ্যে তদতিরিক্ত আর কেহ নেই। ইহাই হল চরম ও পরম সত্য। এই গুরুই সচ্চিদানন্দ স্বয়ং। তিনি স্বয়ংপূর্ণ, স্বয়ংপ্রকাশ, নির্গুণ, সগুণ ও নির্গুণ-গুণী স্বয়ং। তিনি নির্গুণ-গুণময়, নিত্যলীলাময়। তিনি নিজের মধ্যে নিজেকে স্বভাবে বহু কল্পনা করে বৈচিত্র্যরূপে নিজেকে প্রকাশ করেন। বৈচিত্র্যের মধ্যে নিজে অবস্থান করে নিজেই তা আস্বাদন করেন; আবার সবই নিজের মধ্যে নিজে গুটিয়ে নেন।

Capture

সদ্‌গুরুর মাহাত্ম্য –

দেহরোগের ওষুধ মেলে ডাক্তারের কাছে এবং ভবরোগের ওষুধ মেলে মহাত্মা মহাপুরুষদের কাছে। সদ্‌গুরুর মুখনিঃসৃত বাক্য হল শাস্ত্রের সার ও মন্ত্রতুল্য। গুরুবাদ হল অধ্যাত্ম সাধনের শ্রেষ্ঠ মাধ্যম। গুরুসেবা হল শ্রেষ্ঠ পূজা। গুরুর মূর্তি-ধ্যান হল শ্রেষ্ঠ ধ্যান। গুরুর বাক্য হল শ্রেষ্ঠ মন্ত্র। গুরুর জ্ঞান (তত্ত্ব) হল শ্রেষ্ঠ জ্ঞান। গুরুর কৃপা হল শ্রেষ্ঠ কৃপা। সদ্‌গুরু হলেন ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বরের ঘনীভূত মূর্তি এবং ব্রহ্ম আত্মার মূর্ত স্বরূপ। এই গুরুই হলেন সংসার ও অধ্যাত্মজীবনের উপায়, উপেয় এবং পরাগতি…।

Capture

গুরুশক্তির মহিমা –

মানুষকে ভিন্ন ভিন্ন আবর্তের মধ্যেই ঘুরপাক খেতে হচ্ছে। গুরুশক্তির সাহায্যেই একটার পার হতে হয়। গুরুশক্তি ও cosmic power একই কথা। সত্ত্বগুণী আধারের মধ্যে দিয়ে সেই universal power সাধকের ভিতরে কাজ করে। তাকেই গুরুশক্তি বলা হয়। Impersonal being যখন personal being-এর মধ্যে কাজ করে, তখন তাকেই গুরুশক্তি বলা হয়। সেই শক্তিকে প্রতিহত করার মত কোন শক্তি নেই, এমনকি দেবশক্তিরও ক্ষমতা নেই…।[read more=”Read More…” less=”Read less”]পাহাড়পর্বতে যাঁরা ধ্যান করেন তারাও বলেন যে সারাজীবনের সঞ্চিত চিন্তার বৃত্তিগুলি ধ্যানের সময় বুদ্বুদ আকারে ভেসে ওঠে। এই সব কুবৃত্তি নষ্ট করার জন্য গুরুশক্তির দরকার হয়। যে যার কাছে আশ্রয় নেয়, সে তাকে রক্ষা করে। গুরুর ওপর নির্ভর করলে বা তাঁর সাহায্য চাইলে তিনি এই কুবৃত্তিগুলিকে দমন করতে সাহায্য করেন; উপরন্ত তার ভিতরের দুষ্কৃতির বৃত্তিগুলিকে centre-এর দিকে চালিয়ে Divine করে দেন। লঘুকে গুরুত্বে বরণ করে ছেড়ে দেন। বাইরে গুরুবাদ সম্বন্ধে অনেক কথাই শোনা যায়। গুরুর কাছ হতে মন্ত্র নেবার সময় গুরুকে ঈশ্বরবোধে গ্রহণ করতে হয়।[/read]

Capture

চতুর্বিধ স্তরের গুরুর পরিচয় –

স্থূলগুরু – স্থূলগুরুর প্রয়োজন হলে সাধু-সন্ন্যাসীর কাছে যেতে হবে।
সূক্ষ্মগুরু – শাস্ত্রপাঠ ও মহাপুরুষদের বাণী শ্রবণ দ্বারা সূক্ষ্মগুরুর প্রয়োজন মেটে।
কারণগুরু – মহাপুরুষদের কাছ হতে যে স্মৃতি সংগ্রহ হয়েছে সেগুলি মন্থন করা ও ধ্যান করা। ইহাই হল তৃতীয় গুরুর সঙ্গ করা।
মহাকারণগুরু – একেবারে প্রশান্ত হয়ে যাওয়া। এই অবস্থায় মনে হবে আমি সমগ্র বিশ্বের কাছে ঋণী। ভাল-মন্দ, সুন্দর-অসুন্দর সবকিছুর মধ্যে দিয়ে তিনি অর্থাৎ এই চতুর্থ গুরু আমাকে একটা বোধ দিয়ে যাচ্ছেন। তখনই জীবনের পরিপূর্ণ রূপান্তর হয়। এই অবস্থায় চতুর্থ গুরুমূর্তির প্রকাশ হয়।

Capture

শ্রবণের পরিণাম –

সদ্‌গুরুর কোন স্বার্ধ নেই, তাঁর অহংকারের লেশমাত্রও নেই। তাই শিষ্য যে কে কী রকম হবে, কতটা কার হবে তা তিনি জানেন সত্য, কিন্তু বলেন না। তাঁর এই দেহের মাধ্যমে স্বয়ং ভগবানই বীজ দিয়ে যান। এই ব্যক্তিগুরুর কোন কিছুতেই কোন অধিকার নেই। সেইজন্য বারবার বলা হয় – ‘এর’ (নিজের দিকে ইঙ্গিত করে) সাধু সন্ন্যাসী হবার ও অধিকারও নেই। এখানে বারবার বলা হয় – ভার যখন সব চিদানন্দময়ী মায়ের ওপর, তখন কেউ ঠকবেনা। তবে জমি বুঝে চাষ হয়। কোন জমিতে কোনটা ভাল হবে সেটি তাঁর হাতে। তাঁর জন্য প্রতীক্ষা করেই দেখা জাক না কী হয়। এমনিতেও প্রতীক্ষা করে বসে থাকতেই হত, তবে সেটাও তাঁকে বাদ দিয়ে নয়।
গুরু ইষ্ট ভগবান সর্বক্ষণ সকলের সঙ্গে সঙ্গেই থাকেন। এই বিষাসটি নিয়ে চলতে হয়। এই বিষাসই যে মানুষকে টেনে কথায় নিয়ে যেতে পারে তার সীমা নেই।

Capture

গুরুর কর্তব্য –

জীবনের যে কত problem, এসব কিছুর সঙ্গে সংগ্রাম করতে করতেই মানুষের শক্তি নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। গুরুরা এসে একটু tune করে দিয়ে যান। সহ্য করার শক্তিটা আস্তে আস্তে বাড়িয়ে দিয়ে যান। তা না হলে মানুষ unbalanced হয়ে যায়। সেই জন্যই সকলের সৎসঙ্গ করা দরকার। তাহলে ঐশী শক্তির সঙ্গে সমতা রেখে সকলের চলা সম্ভব। বাইরের ঘাত-প্রতিঘাতে যদি unbalanced হয়ে যায় কেউ তবে অখণ্ড সত্যকে কী করে নেবে? যত বেশি ঘাত-প্রতিঘাত থাকে ততবেশি balanced nature হয়, ততবেশি অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হয়। ঘাত-প্রতিঘাতের ফলে মানুষ steady হয়। শক্তির পরীক্ষায় যারা স্থির হয়ে থাকে তারা maximum শক্তিমান পুরুষ। আধ্যাত্মিক পথে ইহাই হল training। সদ্‌গুরু যাঁরা তাঁরা তাঁদের শিষ্যদের যে কীভাবে তৈরি করছেন তা দেখলে ও শুনলে তাঁদের কাছে এগোতেই কেউ সাহস পাবে না।

Capture

সর্ব অবস্থায় গুরুই সকলকে ধরে রাখেন –

গুরু কিন্তু সকলকে ভিন্ন ভিন্ন অবস্থাতেও ধরে রেখেছেন। গুরু যখন সৃষ্টিমুখী হন তখন ব্রহ্মা, যখন পালন করেন তখন বিষ্ণু এবং যখন ধ্বংসমুখী হন তখন মহেশ্বর। এর পরেও তাঁকে বলে হয় পরমব্রহ্ম। তাহলে প্রত্যেকের গুরুই ব্রহ্ম। তারপরেও বলা হয় পরব্রহ্ম, পরাৎপরব্রহ্ম। তারপরেও indication দেওয়া আছে। তাহলে দেখা যায় প্রত্যেকেই বিরাট আশ্রয়ে বাস করে। মুশকিল হয় যে তাঁর কথা সকলের মনে পড়ে না। মনে পড়লেই শান্তি। গুরুর মহিমার অন্ত নেই। অনেকে অনেক সময় গুরুর দোষত্রুটি দেখে। মহিমার কথা সামনে ধরে দিলে দোষত্রুটির প্রশ্নই আর আসে না।
গুরু হলেন প্রেমঘন মূর্তি। অবাধ্য সন্তানকেও গুরু ত্যাগ করেন না। গুরুর কাছে ত্যাগ বা বর্জন বলে কিছু নেই। তবে তিনি সুযোগের জন্য অপেক্ষা করেন বা প্রতীক্ষা করেন। ক্ষতি যেন না হয় সেদিকে সতর্ক থাকেন। যখন তখন তাড়াহুড়া করে ভাল করতে গেলে অধিকতর ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে।

Capture

জগতের সর্বত্র সর্বকর্ম যে শক্তি দ্বারা সম্পন্ন হয় তা তত্ত্বত গুরুশক্তি –

গুরুরা যখন মনে করেন যে শিষ্য গ্রহণ করতে পারবে না, যোগ্যতা নেই, তখন তাঁরা misuse হবে বলে তাকে তা দেন না। অথচ লোকে বলে গুরু দেন না। আসল কথা গহণ করতে এবং তা ব্যবহার করতে সবাই চায় না এবং জানেও না।
গুরু সবার ঊর্ধ্বে পরমব্রহ্ম। তাঁর অধীনে ক্রম অনুসারে শিব, বিষ্ণু ও বাহ্যত পিতামাতা। জ্ঞানমাত্র, শক্তিমাত্র, আনন্দমাত্রই গুরু; কার্য-কারণ মাত্রই গুরু। অখণ্ডের দৃশটিতে গুরুর বাইরে কেউ নেই। সুতরাং সকলে গুরুর মধ্যেই আছে। যে যে-অবস্থায় আছে তার চেয়ে বৃহত্তর অবস্থায় যেতে হলে অখণ্ডবোধে গুরুকে মেনেই যেতে হবে। গুরু নিত্য একজনই। সর্বত্র সবকিছুর মধ্যেই তিনি মিশে আছেন। অন্তরে-বাইরে তিনিই আছেন। তাঁর বাইরে এক মুহূর্তও কেউ যেতে পারে না। সকলে তাঁর সত্তাতেই সত্তাবান এবং তাঁর শক্তিতেই শক্তিমান। তাঁকে ছাড়া কারোর কিছু করারই ক্ষমতা নেই। তিনিই সকলকে চালনা করেন। সুতরাং গুরুশক্তিকে অবহেলা করার উপায় নেই।[read more=”Read More…” less=”Read less”]‘তোমার গুরু’ বা ‘আমার গুরু’ এরকমভাবে বলা অজ্ঞানীর মত ও ছেলেমানুষের মত ঝগড়া। কারণ গুরু এক। সত্যানুভূতির শেষ পর্যায় দেখা যায় যে একমাত্র তিনিই রয়েছেন, আর কেউ নেই। এই অনুভূতির আসবার জন্যই যত কিছু সাধনভজন।
ব্রহ্মরূপ গুরু ব্রহ্মবিদ্যারূপে অন্তরে প্রবেশ করে ব্রহ্মজ্ঞান জাগিয়ে দেন। মানুষ যে যা-ই করে সে সব সম্পন্ন হয় গুরুশক্তি দ্বারা। ‘আমি করি’ বা ‘আমি চলি’ এভাবে ভাবা হল অহংকারের কাজ। তাঁর শক্তিতেই যখন সবাইকে চলতে হয় তখন তাঁর হয়ে করা, তাঁর দাস হয়ে চলা বা যন্ত্রবৎ হয়ে থাকা – এইভাবে নিয়ে চলতে হয়। মানুষের অজ্ঞাতসারে তিনিই সবাইকে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। কারোর নিজের চেষ্টায় একটি শ্বাস-প্রশ্বাস ফেলবার সামর্থ্য নেই। ক্রমশ এই বোধ এসে গেলেই মুক্তির আস্বাদন করা যাবে। ‘আমি’, ‘আমার’ বোধ চলে গেলে হয় মুক্তির আস্বাদন। মায়ের কোলে, গুরুর কোলে থেকে আমরা বলি, আমরা চলি, আমরা করি – এইভাবে অহংকার করার জন্যই জগতে মার খেয়ে মরতে হয়।
গুরু বললেই impersonal বোধে নিত হবে। প্রয়োজনবোধে তিনি কখনো কখনো Personal Being হিসাবে আসেন। তা না হলে ‘গুরুর্ব্রহ্মা’, ‘গুরুর্বিষ্ণু’ প্রভৃতি বলা চলে না। নাম-রূপে থেকেও তিনি নাম-রূপ-ভাবের অতীত।[/read]

Capture

মহাপ্রাণের আরেক নাম গুরু

গুরু একজনই। তিনি জানেন কীভাবে কাকে help করতে হবে। Divinity speaks through innerscient. Silence-এর মধ্যে তাঁর নির্দেশ শুনতে হবে। মন ও হৃদয় যখন শান্ত হয় তখন যে ভাবটি ফুটে ওঠে সেটাই তাঁর নির্দেশ। তাই সকালে নিদ্রাভঙ্গের পড়ে ঈশ্বরভজনের কথা বলা হয়।
গুরু বললে মহাপ্রাণ বা ব্রহ্মকে বুঝতে হবে। তাহলে গুরু হতে আর বিচ্ছেদ কখনো হয় না। তখন অনুভূত হয় যে গুরুই সবাইকে ধরে রেখেছেন। ধর্মকর্মও কেউ নিজে করতে পারে না। গুরুই সকলের মধ্যে বসে ধর্মকর্ম করেন। এইভাবে চললেই শান্তিলাভ হয়। তা না হলে শান্তি কোথাও পাওয়া যায় না।

Capture

গুরুকে অতিক্রম করা যায় না

সর্ব দুঃখ-অশান্তির মূলে হল ‘আমি-আমার’ বোধ পোষণ করা। যত বেশি ঈশ্বরীয় সত্তা বা গুরুসত্তার অনুগত প্রিয় ও বাধ্য হওয়া যায় ততই শান্তি। যতটা তাঁর মধ্যে মিলিয়ে যেতে পারা যায়, তাঁর প্রকাশ বা বশ্যতা মেনে নেওয়া যায়, তত বেশি শক্তি পাওয়া যায়। তাই সকলকে উদ্দেশ করে বলা হয় গুরু বা ইষ্ট হল শান্তির আশ্রয়। গুরু বা ইষ্টের আশ্রয়ে চললে ভয় নেই। তখন আমি, আমার’ বোধ ক্রমশ চলে যায়, অহংকার বিদূরিত হয় এবং দুর্ভোগও কেটে যায়।
মহাপ্রভু চৈতন্যদেব হালিশহরে গুরু ঈশ্বর পুরীর কাছে গেলেন। গুরু দেহে না থাকা সত্ত্বেও তিনি সেখানকার মাটি আঁচলে বেঁধে নিয়ে এসেছিলেন। এইসবই তো শিক্ষণীয়। স্বয়ং অবতার হয়েও গুরুর কী রকম অনুগত…।
গুরুর কথা, আচরণ ও কাজের সমালোচনা করতে চেষ্টা করলে ক্ষতি হয়। গুরুকে কখনো অতিক্রম করা যায় না। গুরুকে, ইষ্টকে সকলেই স্মরণ করে। মহাপুরুষগণও গুরুকে প্রণাম করেন। আচার্য শংকর অদ্বৈতবাদী ছিলেন; তথাপি তাঁর গুরুর প্রতি নিষ্ঠা অতুলনীয়।

Capture

অখণ্ডবোধে গুরুর পরিচয় –

সচ্চিদানন্দকে আনন্দঘন ও প্রেমঘন বলে ধরাই ভাল। জ্ঞানঘন বা শক্তিঘন ভাবলে শক্তি চাওয়ার প্রবৃত্তি আসে। প্রেমের মধ্যে থাকলে আর unbalanced হয় না। গুরুমূর্তি প্রেমঘন। প্রেমঘন বললে মনে হয় – আমার অতি আপনজন, প্রাণের প্রাণ, মনের মন। কিছু গোপন করার ইচ্ছা আর থাকে না। নির্জনে গুরুর উদ্দেশে (যেন তিনি সানেই উপস্থিত আছনে এই ভাবনা করে) নিজের সুবিধার কথা বলা চলে। অন্তরে তিনি যেমন আছেন তেমনই সম্মুখে-পশ্চাতে, অধঃ-ঊর্ধ্ব সর্বত্র তিনি সমানভাবেই আছেন। ভুল-ত্রুটি, ইচ্ছা-অনিচ্ছা যা খুশি প্রতিটি কথাই তাঁকে বলা যায়। তিনি শুনবেনই। যা খুশি তাঁকে নিবেদন করা চলে, তিনি তা শোনেন। তিনি ইষ্ট এবং গুরু। তাঁর থেকে কখনো বিচ্ছেদ হয় না। ইহাই হল সর্বাপেক্ষা ভরসার কথা। তিনি নিত্যকাল ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন। তাঁর মধ্যে আমি নিত্য আছি। আমার মধ্যে তিনি আছেন এটা না জানতে পারলেও, তাঁর মধ্যে যে আমি আছি এটা অতি বড় সত্য কথা। এইভাবে ভাবনা দ্বারা তাঁর ওপর ভরসা বা নির্ভরতা রাখতে হবে। তার ফলে বিশ্বাসের মাত্রা বাড়ে এবং অশান্তি চলে যায়।[read more=”Read More…” less=”Read less”]গুরু রূপে থেকেও রূপাতীত, নামে থেকেও নামাতীত, ভাবে থেকেও ভাবাতীত। গুরু নিজেই এসে ধরা দেন। তিনি বিজ্ঞানময় বলে প্রতিটি জিনিসের মধ্যেই তিনি ধরা দেন। কেউ যখন গুরুমূর্তির সম্মুখীন হন তাঁর যেন মনে থাকে যে গুরুই কল্যাণ করে যাচ্ছেন সর্বতোভাবে। যে গুরুই হোক না কেন, এমনকি পাঠশালার গুরুও গুরুপদবাচ্য। কোন গুরুরই দোষ দর্শন করতে নেই। সমস্ত বস্তুর মধ্যে গুরুকে দর্শন করার অর্থ ব্রহ্মদর্শন। রহ্মদর্শন ও গুরুদর্শন একই কথা। একজন জল চায়, আরেকজন বলে water দাও – অর্থ কিন্তু একই।
গুরুকে আপনবোধে বা প্রিয়বোধে নিতে পারলে এবং সমস্ত কর্মে গুরুকে বসাবার যোগ্যতা এলে বিরোধ, অস্থিরতা, চঞ্চলতা আর আসে না। ফলে, কর্মের ফলও আর ভোগ করতে হয় না। সাধু মহাপুরুষগণ কখনো বসে থাকেন না। সর্বদা তাঁরা নাম করেন। ফলে ভগবৎ মহিমা থেকে তাঁরা সরে যান না। তাঁর নিত্য একেরই মহিমা গুণগান করেন।
গুরু বললে অখণ্ড মূর্তি বলে ভাববে। খণ্ড খণ্ড করে ভাবতে নেই। Liking, disliking দিয়ে ভাগ ভাগ করলে গুরুকে অশ্রদ্ধা করা হয়, গুরুকে ভালবাসা হয় না। গুরু তাঁর শিষ্য ভক্তদের সমানভাবে ভালোবাসেন; যদিও প্রয়োজনবোধে অনেক সময় বাহ্যিক দৃশটিতে তারতম্য দেখা যায়। এবিষয়ে উদাহরণ স্বরূপ একটি গল্প বলছি শোন।
এক গুরুর আশ্রমে পাঁচ জায়গা থেকে পাঁচ রকম শিষ্য এসেছে। গুরু তাদের সঙ্গে ভিন্ন ভিন্ন রকম ব্যবহার করেন। এই দেখে একজন জিজ্ঞাসা করেই ফেলল – “এরকম বৈষম্যমূলক ব্যবহার কেন আপনার?” গুরু তখন কোন উত্তর দিলেন না।
রাত্রিতে খাওয়ার সময় একরকম খাদ্যই তিনি সবাইকে পরিবেষণ করলেন। তখন সেই শিষ্যটি বলল – “এইরকম খাবার আমার পেটে সহ্য হয় না”। তখন গুরু বুঝিয়ে দিলেন যে এই খাদ্যের বেলায় যেমন একপ্রকার খাদ্য সকলের সহ্য হয় না, প্রয়োজন অনুসারে ভিন্ন ভিন্ন খাদ্যের প্রয়োজন হয়, সেইরূপ প্রয়োজন অনুসারেই গুরু প্রত্যেকের সঙ্গেই ভিন্ন ভিন্ন ভাবে ব্যবহার করেন।
গুরু জানেন কার সঙ্গে কীরূপ ব্যবহার করলে তার কল্যাণ হয়। আমাদের ভবব্যাধি মুক্ত করার জন্য এমন যে প্রেমঘন কল্যাণময় গুরু রয়েছেন তাঁর কাছে ছুটে যেতে হয়। গুরুর স্নেহ কিছু দিয়েই মাপা যায় না। তিনি দেবার জন্যই এসেছেন। তাঁকে যদি কেউ না চায় বা না ডাকে তবুও তিনি দিয়েই যান সর্বদা, তবে তাঁকে ডাকলে এবং সম্পর্ক হলে জানা যায় যে তিনিই দিচ্ছেন সবকিছু – ফলে তাঁর ওপর নির্ভরতা আসে। কিন্তু যারা গুরুর আশ্রয় নেয়নি, তারা জানে না যে গুরু সর্বদাই সাহায্য করছেন, ফলে তারা সর্বদাই অশান্ত ও অস্থির চঞ্চল হয়ে থাকে।
গুরুকরণ হওয়া সত্ত্বেও যদি শিষ্য সেরূপ নির্ভর না করতে পারে তবে তারাও চঞ্চল ও অস্থির হয়। কল্যাণময় গুরু সকলের মধ্য দিয়েই কাজ করছেন। তবে যারা সচেতন থাকে তারা বিশ্বাস করে নিশ্চিন্ত হয়ে জীবনযাত্রা নির্বাহ করে, কোন কিছুতেই চঞ্চল হয় না। তারা জানে গুরুশক্তিতে সব কিছুই সহজ হয়ে যাবে। বিশ্বাসী মন কখনো অস্থির হয় না। দারিদ্য, রোগ, শোক ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ কখনো তাদের অস্থির করে না। তাদের চাল-চলন, আচার-ব্যবহার দেখলেই শিক্ষা পাওয়া যায় যে এভাবে নির্ভর করলে কীরকম শান্তি পাওয়া যায়। কিন্তু কাউকে কখনো ঈর্ষা করতে নেই।
প্রকৃত সাধু সন্ন্যাসীরা অপরের কল্যাণী শুধু চান। যেখানে যে অবস্থাতেই তাঁরা থাকেন না কেন বিশ্বের কল্যাণই তাঁরা সর্বদা কামনা করেন। ‘যিনি সর্বদা সকলের কল্যাণকামী তিনিই যথার্থ সাধু’।[/read]

Capture

প্রেমে গড়া প্রেম ভরা হৃদয় যাঁর তিনিই মহাপুরুষ, সদ্‌গুরু –

মহাপুরুষদের হৃদয় প্রেম ভালোবাসায় পূর্ণ থাকে। তাঁদের কথা চিন্তা করলে বা তাঁদের স্মরণ করলে মন শান্ত হয়। যে মহাপুরুষকে কোনদিন আমি চোখে দেখিনি তাঁকে স্মরণ করেও উপকার পাওয়া যায়; কারণ দেহে না থাকেলও তাঁরা কালাতীত, তাঁরা ‘নিত্য বর্তমান’। কালের মধ্যে তাঁরা লীলা করছেন। বিশ্বাস করে তাঁদের স্মরণ করলে তাঁরা কল্যাণ করেন। আর যারা অবিশ্বাসী তাদের মধ্যে কাল নৃত্য করে। যত গুরু মহারাজ, মহাপুরুষ সকলের সঙ্গেই আমাদের সম্বন্ধ রয়েছে, যোগাযোগ রয়েছে। তার ফলে কোন সাম্প্রদায়িক ভাব নেই। শাক্ত বললে শাক্ত, বৈষ্ণব বললে বৈষ্ণব, মুসলমান বললে মুসলমান, খ্রিস্টান বললে খ্রিস্টান। কারণ সবাই আমরা চলেছি – ‘সত্য এক, ধর্ম এক, কর্তা এক’ এই বিষাসটি ধরে। সব মহাপুরুষগণ এই কথাই বলেন। তাঁদের নির্দেশগুলি কত সুন্দর। তাঁদের সেই শান্ত প্রেমঘন মূর্তি স্মরণ করলেই সকলের কল্যাণ। অমৃতত্ব লাভ করতে হলে তাঁদের অমৃতঘন মূর্তি স্মরণ করলেই চলবে।
ভক্ত সত্য-মিথ্যা, ভাল-মন্দ কোনটির মধ্যে পার্থক্য দেখে না। সবকিছুই তার কাছে গুরুমূর্তি। দুঃখ-কষ্ট এলেও তারা গুরুর ওপর নির্ভর করে থাকে। তার ফলে দেখা যায় দুঃখ-কষ্ট আসতে আসতেও সামান্য একটু ধাক্কা দিয়েই সরে যায়।

Capture

গুরুর মাহাত্ম্য –

‘গুরুর পদ, শিষ্যের মাথা’। গুরুর মাথা শিষ্যকে না চালালে শিষ্য কী করে চলবে? গুরু যদি শিষ্যের মাথায় বসেন, তবে তো সে শুধু ভুল-ভ্রান্তি করবে। গুরু হলেন সারথি। তিনি শিষ্যকে নিয়ে চলছেন। গুরুর body-র দরকার হয় না। শিষ্যের বুদ্ধির মধ্যে বসে যিনি শিষ্যেকে চালাচ্ছেন তিনিই তো গুরু। কাম, ক্রোধ কিছুতেই নিজে নিজে প্রতিহত করতে পারা যায় না যতক্ষণ না গুরুশক্তি সেটা দমন করেন। অহংকার বা ‘আমি-আমার’ বোধটিই একমাত্র বন্ধন। যত বেশি তাঁর শরণ নেওয়া যায় ততই ‘আমি-আমার’ ভাব চলে যাবে। প্রদীপের তেল ফুরিয়ে গেলে যেমন আবার তেল ঢালতে হয় সেইরকম সৎসঙ্গ থেকেও মাঝে মাঝে তেল সংগ্রহ করতে হয়।

Capture

গুরু অন্তরে-বাইরে নিত্য বর্তমান –

গুরু বলে স্থূলদেহকে ধরলেও তার একটি স্মৃতি থাকে। বাইরে স্থূলরূপে যা দেখা যায় ভিতরে তা বোধের বৃত্তিরূপে আছে। তাকেই সূক্ষ্মরূপ বলা হয়। এই সূক্ষ্মরূপে গুরু প্রাণের মধ্যে, মনের মধ্যে ও বুদ্ধির মধ্যে অঙ্গাঙ্গিভাবে মিশে রয়েছেন। কাজেই বাইরে স্থূলরূপে তাঁকে না পেলেও তিনি আমার অন্তরে সর্বদাই আছেন – ইহা স্মরণে রাখতে হয়।
সদ্‌গুরুর কাজ শিষ্যকে শুধু বলে দেওয়া যে তুমি যত প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেই পড়, শুধু তাঁকে একটু ধরে থেক। তাহলেই তুমি সর্বপ্রকার প্রতিকূল অবস্থা অতিক্রম করতে পারবে। প্রতিকূল অবস্থা চিরকাল থাকে না। প্রতিকূল অবস্থাগুলিরও তাৎপর্য আছে। ইহা সকলকে জাগ্রত করে দেবার জন্য আসে। অজ্ঞান না থাকলে জ্ঞানের মূল্য নেই।

Capture

তত্ত্বস্বরূপে জ্ঞান ও ভক্তি অভিন্ন –

গুরু ও শিষ্যের সম্বন্ধ যেন বাবা-মা ও সন্তানের সম্বন্ধ। সন্তানের দুঃখ-কষ্টে মা-বাবার যেমন দুঃখকষ্ট এবং সন্তানের উন্নতিতে মা-বাবার যেমন আনন্দ হয় সেইরকম গুরুও শিষ্যের দুঃখ-কষ্টে দুঃখ হয় এবং শিষ্যের আনন্দে আনন্দ হয়। গুরু-শিষ্যের সম্পর্ক ঠিক মা ও সন্তানের মত।[read more=”Read More…” less=”Read less”]গুরুকে আমার প্রয়োজন এইভাবে ভাবতে নেই। গুরুর কাজে আমি সহায়ক হব এই বোধে নিতে হবে। তাহলেই গুরু আমার মধ্যে প্রকাশ হবেন। নয়তো লঘু হয়েই থাকতে হবে। গুরু কাজ করতে পারেন না আমরা আমাদের egoism (অহংকার) দিয়ে বাধা দেই বলে। গুরুকৃপা পায় না বলে যারা অভিযোগ করে, তারা খেয়াল করে না যে তারা নিজেরাই ‘আমি আমার’ বোধের ব্যবহার দ্বারা প্রতি মুহূর্তে নিজেদের মনকে নিজেরাই চঞ্চল করে তোলে। তাই গুরু তার মধ্যে কাজ করতে বাধা পান। কারো বিশ্বাস যেন কোন প্রকারেই নষ্ট না হয় সেজন্যও প্রার্থনা করতে হয়। গুরু সর্বদাই চান মানুষকে তার lower nature থেকে upper nature-এ তুলে নিতে। কিন্তু নিম্ন প্রকৃতির সংস্পর্শে এসে মানুষের প্রকৃতি নিম্ন দিকেই যেতে চায়।
সদ্‌গুরু অবতীর্ণ হয়ে ধরিয়ে দেন – সত্যকে কীভাবে ব্যবহার করে সত্যময় হওয়া যায়, জ্ঞানকে কীভাবে ব্যবহার করলে জ্ঞানবান হওয়া যায়, শক্তিকে কীভাবে ব্যবহার করে শক্তিময় হওয়া যায়।
একটি মাত্র শক্তিই আছে তাকে গুরু, শক্তি, মাতা, ইষ্ট যে কোন নাম দেওয়া চলে। Partial acceptance হলে এইভাব আসে না। Total acceptance হলেই এইভাব আসে। আমার ঈশ্বর বা গুরুই সকলের মধ্যে রয়েছেন তাঁকেই আমি প্রীত করব, সেবা করব, তুষ্ট করব। এইভাবে সেবা হলেই গুরু তুষ্ট হন। গুরু শুধু আমার তুষ্টি ও প্রীতির জন্য নয়। প্রতিটি প্রকাশকেই ঈশ্বরবোধে বা গুরুবোধে সেবা করে যেতে হয়। তাহলে দুঃখ-কষ্ট দুর্ভোগ সবই আস্তে আস্তে কমে যায়।
সদ্‌গুরু যাঁরা, তাঁরা কখনো ধৈর্য হারান না। অতি ধীরে ধীরে humble হয়ে তাঁরা তাঁদের কাজ করে যান। তাঁরা জানেন তাঁদের মধ্যে Divine Mother স্বয়ং-ই বসে কাজ করেন। তাঁদের কোন দায়িত্ব থাকে না। এক body-তে কাজ যদি সমাপ্ত না-ও হয়, তবে আর একটি body ধারণ করেন। সদ্‌গুরু মানেই Divine Mother । তাঁরা বহুজন হিতায় কাজ করে যান। তাঁরা আসেন to embrace all । Personal একটা body-তে বসে স্বয়ং Divine Mother-ই কাজ করে যান।[/read]

Capture

গুরুবাদের তাৎপর্য –

গুরুবাদের প্রথম কথাই হল যে গুরুই প্রতিমুহূর্তে সকলকে ধরে রেখেছেন। অহংকার চলে গেলে ইহা ধীরে ধীরে অনুভব কর যায়।

Capture

সদ্‌গুরুর লক্ষণ –

সদ্‌গুরুকে বলা হয় পুরুষোত্তম ভগবান। তিনি আত্মস্বরূপে স্থিত হয়েছেন এবং একত্বে পৌঁছেছেন।[read more=”Read More…” less=”Read less”] তিনিই মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক পাতিয়ে তাকেও স্বরূপে প্রতিষ্ঠিত করে দেন বা একেতে পৌঁছে দেন। ইহাই সদ্‌গুরুদের প্রাণের ধর্ম। তাঁদের প্রাণের ধর্ম হল স্নেহ, প্রীতি, করুণা, মৈত্রী, অনুকম্পা, ভালোবাসা সহানুভূতি। এই দিয়ে তাঁরা সবকিছু প্রাণময় করে তোলেন। এই অবস্থাতেই প্রাণকে সবকিছুর মধ্যে আপনবোধে পাওয়া যায়। প্রাণের নয়ন হল বোধনয়ন। ই বোধনয়নের কাজ শুধু এককে দেখা। মানুষের স্থূলনয়নে মনের কাজ বেশি বলে বহু দেখে। প্রজ্ঞাস্থিতি হলে বোধনয়ন কাজ করে। জীবনে সত্ত্বগুণ যত বাড়ানো যায়, ততই জীবন প্রাণধর্মী হয়ে যায় এবং আপনবোধ বেড়ে যায়।
সদ্‌গুরুগণ সংসারে সকলের সঙ্গে মিশে থাকলেও সবকিছুতে তাঁরা নির্লিপ্ত থাকেন। সদ্‌গুরু মাত্রই পুরুষোত্তম। তাঁরা ভগবানের সঙ্গে স্বধর্ম প্রাপ্ত হয়ে যান। সর্বজিনিসে প্রীতিবোধ ও সমবোধ হল ইহার লক্ষণ।[/read]

Capture

দুঃখমূর্তি হল গুরুরই একটি রূপ। –

সবকিছুর মধ্যে গুরুকে অখণ্ড বোধে মানতে হয়।

Capture

গুরুশক্তির কাছে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে সমর্পণ করলেই সার্বিক উন্নতি সম্ভব –

কীভাবে জীবনে চলাফেরা ও আচরণ করলে total development হয় তা শ্রবণের প্রয়োজন। একদিনে ইহা সম্ভব না। কী করে ধীরে ধীরে উপজুক্ত করে উন্নত স্তরে নিয়ে যান তা তিনিই জানেন। গুরুশক্তির ওপর পরিপূর্ণভাবে নিজেকে সমর্পণ না করলে তা হয় না। যেমন চাষীর কাছে জমি না ছাড়লে ফসল হয় না। সবকিছুকেই যদি সর্বদা গুরুবোধে গ্রহণ করা হয় তাহলে ঠকতে হয় না। নিজের মতন করে ভাবনা করলে ঠকতে হয়। Imperfect অবস্থার সঙ্গে মেলাতে গেলে perfection হয় না। সমগ্র বিশ্বই গুরুমূর্তি। এই বোধে সব মানতে পারলেই গুরুর মহিমা ও তার তাৎপর্য পূর্ণভাবে হৃদয়ঙ্গম হয়। ইহাই হল আসল গুরুমূর্তি যাঁর মধ্যে আমরা সকলে আছি। ঋষিরা এই বিশ্বকে ভাল করে study করে দেখেছেন। তার তাঁরা বলেন – যা আছে ভিতরে তা-ই আছে বাইরে এবং যা আছে বাইরে তা-ই আছে ভিতরে। কল্যাণকর কিছু কাজ করতে গিয়ে প্রয়োজন হলে অনেক কিছু ধ্বংসও করার দরকার হয়।

Capture

যে কোন ভাবেই হোক গুরুকে সর্বদা স্মরণে রাখতে হয়

গুরুকে প্রথমে বোধের মধ্যে বসাতে হয়। তাহলে গুরু সম্বন্ধে ভিন্ন ভিন্ন ভ্রান্ত ধারণা আর থাকে না। তার পরে মনের মধ্যে, তারপর প্রাণের মধ্যে এবং তারও পরে ইন্দ্রিয়ের মধ্যে বসাতে হয়। গুরুকে মস্তকের উপরিভাগে, পরে মস্তকে এবং তারপরে সর্ব অঙ্গে ভাবনা করতে হয়।
মনের মধ্যে সংকল্প-বিকল্পরূপে গুরুই বসে আছেন। তাই প্রার্থনা করে বলতে হয় তোমার ইচ্ছাই যেন আমার ইচ্ছা হয়। ইন্দ্রিয়ের মধ্যে বসে তিনি সর্বকর্ম করেন। তাই প্রার্থনা করে জানাতে হয় – সবই তোমার কর্ম। এর মধ্যমে তুমিই বসে কাজকর্ম কর। এইভাবে কয়দিন প্রার্থনা করলে খুব তাড়াতাড়ি উন্নতি হয়। এই বিশ্বাস না থাকলে গুরুর সম্পত্তি অর্থাৎ গুণ ঐশ্বর্যগুলি শিষ্যের মধ্যে প্রকাশ হতে পারে না। ঈশ্বরলাভ মানে ঈশ্বরের অভিব্যক্তি ব্যষ্টিসত্তার মধ্যে প্রকাশ হওয়া। ঈশ্বর কোন বস্তু নয়। ঈশ্বরদর্শন মানে সমত্বদর্শন; অর্থাৎ যা সর্ববস্তুর মধ্যে common তা উপলব্ধি করা।
গুরুমূর্তির রূপ হল চৈতন্যময়। গুরুর দেহ চিদ্‌ঘন – চৈতন্য দিয়ে গড়া। শিষ্যের মধ্যে গুরুর অভিব্যক্তি হওয়ার অর্থ হল শিষ্যের চিদ্‌ঘন অবস্থা হওয়া।

Capture

শিক্ষা ও দীক্ষার প্রভেদ –

সকলে যে দীক্ষা নেয়, আসলে তা হল একটি শিক্ষা। দীক্ষা হয় শিক্ষা অনেক দূর এগিয়ে গেলে। একটা নাম অবলম্বন করে নিজেকে উৎসর্গ করার বৃত্তি যখন মনে জাগে তখনই হয় দীক্ষা শুরু। আসল দীক্ষা হয় নিজেকে সমর্পণ করে যখন দিতে চাই। সেই period-এ অন্তরসত্তার সঙ্গে মিলিত হবার জন্য তীব্র ব্যাকুলতা ও আর্তিভাব আসে। পূর্ণভাবে উজাড় করে দিতে না পারলে ত্রিপ্তি হয় না। এর আগের stage পর্যন্ত শিক্ষার স্তরে থাকে। গুরুমহারাজগণ বলেন – একটা ভাব নিয়ে নিয়ে যেন অন্তর-বাইরে সামঞ্জস্য রাখা হয়। ইহার হল শিক্ষার স্তর। তারপরে পরিপূর্ণভাবে উজাড় করে দেবার অবস্থা আসে। তখন আসল দীক্ষার সময় আসে।
একজন মহাপুরুষের এক আশ্রিত ভক্তশিষ্য তাঁর কাছে নাম পেয়ে গুরুমহারাজের সঙ্গেই থাকে এবং খুব নাম জপ করে ও কাজকর্ম করে। সাধারণ লোকে ভাবে – ভক্তটি কত উন্নত, গুরুর কাছে কাছে থাকে ও নাম জপ করে। শিষ্যটি সম্বন্ধে প্রায় সকলেরই এই রকম ধারণা। কিন্তু শিষ্যটির মধ্যে ক্রোধ, হিংসা, স্বার্থপরতা প্রভৃতি সবই রয়েছে। তবু গুরু তাকে কাছে কাছেই রেখেছেন। তার দোষত্রুটিগুলি নামের মাধ্যমে set করিয়ে তার পরে তার আসল দীক্ষা হবে এই জন্য।[read more=”Read More…” less=”Read less”]Lower nature set হয়ে গেলে তার পরেই ধীরে ধীরে সাধককে উন্নত পর্যায় নিয়ে যাওয়া যায়। তখনই হয় তার আসল দীক্ষা। তখন বাহ্যিক কোন ক্রিয়া অনুষ্ঠানের আর প্রয়োজন হয় না। শিষ্যের সমস্ত প্রকৃতি তখন তদগত হয়, কেন্দ্রাভিমুখী গতি হয়।
শিষ্যের ক্রিয়াকলাপ দেখে সকলেরই খুব উচ্চ ধারণা। হঠাৎ একদিন এক ভক্ত তার একটা অন্যায় আচরণ দেখে গুরুদেবকে নালিশ জানাল।
গুরুদেব বললেন – এর আগে তুমিইতো কত প্রশংসা করেছিলে, কিন্তু আজ আবার নিন্দার সুরে কথা বলছ! তোমাদের এ কী রকম বিচারবুদ্ধি? তোমাদের সঙ্গে তার পার্থক্য বিশেষ নেই।
ভক্ত বলল – আপনার সঙ্গে থেকে থেকেও তার এরকম দোষ থাকবে কেন?
গুরুদেব তখন বললেন – অন্তরের বৃত্তি সবার সমান নয়। কারও কঠোর অনুশাসনের প্রয়োজন হয় আবার কারও বা কম শাসনের প্রয়োজন হয়। লোকে ভাবে সাধুসঙ্গ করলেই বুঝি স্বভাবের শোধন হয়ে যায় পূর্ণ ভাবে। আসলে অন্তরে তার সাধুসঙ্গ হয়নি। বাইরেই শুধু সাধুসঙ্গ হয়েছে…।[/read]

Capture

বোধরূপী গুরু বা মাকে অন্তরে বসাতে হয়, বাইরে বসালে লাভ হয় না –

অন্তরে গুরুকে পাওয়া বা ঈশ্বরকে পাওয়া বললে বুঝায় – অন্তরের সব প্রকাশকে বোধের বা চৈতন্যের প্রকাশ বলে নিরন্তর অনুভব করা। বোধ এবং মন এক কথা নয়। মন এই আছে, এই নেই। বোধের পাওয়া হলে নিরন্তর তাঁকে পাওয়া যায়। মন দিয়ে বার বার অভ্যাস করতে করতে living হয়ে বোধের মধ্যে ধরা দেন। ঈশ্বর হলেন বোধমূর্তি। গুরু বা মা বোধময় মূর্তি। মা প্রত্যেকের মধ্যেই আছেন – এই বোধ না হলে এবং সমত্বের মধ্যে না এলে steady হওয়া যায় না।

Capture

গুণের বিকারে ব্রহ্ম-আত্মসত্তাই মানবরূপে প্রতীয়মান হয় –

অন্তরসেবা না হলে divinized হওয়া যায় না। নিজের অন্তরে বা হৃদয়ে গুরুসেবা দ্বারা ভিতরের development হবে; কারণ গুরু ভিতরে বিদ্যমান। কেউ তা ধরে রাখতে পারে না বলেই কৃপা পায় না। মায়ের বা গুরুর আশিস্‌ কৃপা করুণা অনুগহ বা অনুকম্পা সবই অন্তর থেকে reveal করে। মানবরূপ বীজের মধ্য দিয়ে ঈশ্বর বা চৈতন্যঘন বৃক্ষ প্রকাশ পাবে হৃদয় কেন্দ্রে। হৃদয় কেন্দ্রে মানবের চৈতন্যরূপ বীজকে সেবা দ্বারা ঈশ্বরবৃক্ষে পরিণত হতে হবে। ঈশ্বরীয় বৃক্ষে পরিণত হলে ফুলে-ফলে প্রস্ফুটিত হয়ে শোভা পাবে। আবার তার থেকে বীজ হবে। এইভাবেই relation চলবে।

Capture

গুরু বা মায়ের স্বরূপ –

গুরু কোন ব্যক্তি নয়। অখণ্ড চৈতন্যই গুরু। অখণ্ড চৈতন্যসত্তায় যাঁরা প্রতিষ্ঠিত তাঁদের কাছে গেলে জ্ঞানের তাপ অনুভব করা যায়।
Central consciousness-কে বলা হয় মা বা গুরু। আমাদের মা বা গুরু নিত্যকালের গুরু। গুরু কখনো ছোট নন, যাঁকেই গুরুবরণ করা হোক না কেন। যদি কেউ তার গুরুর মধ্যে দোষ দেখে তবে তাদের বলা হয় – দোষ দেখার অভ্যাস না করে গুণ দেখার অভ্যাস কর। মধু-মক্ষিকার মত হতে হবে। মৌমাছিরা যেমন ফুলে ফুলে শুধু মধু সংগ্রহ করে বেড়ায় সকলকে সেইরূপ সবকিছুর মধ্যে সবার মধ্যে বোধরূপী গুরুকেই দেখতে হবে, আর কিছু নয়।
গুরুকে, ব্যক্তিকে, ছবিকে, মূর্তিকে যাকেই গ্রহণ করবে তাঁকে গুরুবহে গ্রহণ করবে। ঈশ্বরকে রূপের মধ্যে দেখলেও অখণ্ড বোধে নিতে হবে। ভাবতে হবে ঈশ্বর বা জগদ্‌গুরুই ভিন্ন ভিন্ন মূর্তিতে প্রকাশমান।

Capture

গুরুকৃপা লাভের উপায় –

গুরু শুধু স্থূলদেহে এসেই কৃপা করেন না। অখণ্ড চৈতন্যসত্তা থেকে তার কৃপা যেন পাওয়া যায় তার জন্যই সৎসঙ্গে শ্রবণের প্রয়োজন হয়। স্বরূপের রসায়ন নিয়ে, একত্বের রসায়ন নিয়ে বহুত্বরূপ ব্যাধি থেকে নিরাময় হতে হবে। ইহাকেই বলে গুরুকৃপা। তাই গুরু বা মায়ের মহিমা আরো শ্রবণের প্রয়োজন। রসায়ন যেন আরো ভালভাবে কাজ করে।

Capture

গুরুকে সর্বদা অখণ্ডবোধে মানতে হবে –

গুরুকে ইন্দ্রিয়ের দ্বারে, শ্রবণের দ্বারে, নয়নের দ্বারে, রসনার মধ্যে, কর্মেন্দ্রিয়ের দ্বারে বুসিয়ে রাখতে হয়। সব আছে প্রত্যেকের নিজের ভিতরেই কিন্তু আবরিত। শুধু ঢাকনি খোলা দরকার। সকলে বাইরে খোঁজে।

Capture

সবকিছুই চিদাত্মগুরুর ভিন্ন ভিন্ন রূপ –

গুরু হলেন যেন ধোপা। তিনি শরণাগত সকলেরই চিত্তমল পরিষ্কার করে ছেড়ে দেন।
গুরুর উপমা দিয়ে গিয়ে একটি গল্প মনে হল, শোন – বাংলা দেশে এক মহাপুরুষ ছিলেন অতি সহজ সরল। একজন তার ছেলেকে নিয়ে এসে তাঁকে বলল – বাবা, আমার এই ছেলেটি বড় অশান্ত। পাঁচজন পাঁচরকম অভিযোগ করে। কী করা যায় একটু উপদেশ দিন।[read more=”Read More…” less=”Read less”]মহাপুরুষ শুধু হেসেই যান, বিশেষ কিছুই বলেন না। শুধু বলেন – ঠিক হয়ে যাবে। প্রতিবারই মহাপুরুষ এই উক্তি-ই করেন। একদিন সহ্য করতে না পেরে ছেলের বাবা বলল – আপনি তো বিশেষ কিছুই বলেন না, একই কথা বার বার বলেন। কিন্তু কোথায়, আমার ছেলে তো ভাল হল না।
মহাপুরুষের চোখ দিয়ে শুধু জল পড়তে লাগল। কোন কথাই আর সেদিন বলেননি। সেই মহাপুরুষ কয়দিন পরে চলে গেলেন। সেই লোকটির সঙ্গে আর দেখা হয়নি। সেই ছেলেটি কিন্তু পরে খুব ভাল হয়ে গেল এবং পরবর্তী কালে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হয়েছিল সে। ছেলেটির বাবা পরে খুব দুঃখ করত মহাপুরুষের কথায় সে তখন বিশ্বাস করতে পারেনি এই জন্য।
মহাপুরুষের চোখ দিয়ে তখন জল পড়েছিল ভদ্রলোকের বিশ্বাসের অভাব দেখে। তিনি ভাবছিলেন তাদের একটু বিষাসও দিয়ে যেতে পারলেন না। এই ভেবেই তার চোখে জল এসে গিয়েছিল।
মহাপুরুষদের কথা সর্বদা সবাই মেনে নিতে পারে না। কিন্তু পূর্ণ বিশ্বাসে মেনে নেওয়া ছাড়াও তো কোন উপায় নেই।[/read]

Capture

*স্ব-স্বরূপলক্ষণ ও বাহ্যলক্ষণের পার্থক্য –

গুরু যতক্ষণ নির্দেশ না দেন ততক্ষন কেউ গুরু হতে পারে না। উপনিষদেও পাওয়া যায় যে এক অন্ধ আরেক অন্ধকে পথ দেখাতে পারে না। যে চক্ষুষ্মান সে-ই অন্ধকে পথ দেখাতে পারে। যার টাকা আছে সে-ই আরেকজনকে টাকা দিয়ে সাহায্য করতে পারে। যার জ্ঞান আছে সে-ই অজ্ঞানীকে জ্ঞান দিতে পারে। যে ঈশ্বরের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সে-ই অপর একজনকে ঈশ্বরের সঙ্গে যুক্ত করে দিতে পারেন।

Capture

সদ্‌গুরু ও সাধারণ গুরু –

সদ্‌গুরু কখনো আদেশ করেন না, তিনি দেন নির্দেশ। নির্দেশ ও আদেশ এক জিনিস নয়। আদেশের মধ্যে জোর থাকে। নির্দেশের মধ্যে জোর থাকে না। শুধু আদর্শটা ধরিয়ে দেবার চেষ্টা থাকে।[read more=”Read More…” less=”Read less”]আধ্যাত্মিক পথে গুরু নির্দেশ দেন। মনুষ্য পর্যায়ের গুরু আদেশ দেন। আদেশে জোর থাকে, নির্দেশে জোর থাকে না, সর্বদা option থাকে। নির্দেশে কোন প্রকার reaction হয় না।
সদ্‌গুরুর attitude একটু ভিন্ন। শিষ্যের development বা capacity কতটা হয়েছে তা জেনেই তবে নির্দেশ দেন, অতিরিক্ত কিছু দেন না তাঁরা। কিন্তু জাগতিক ক্ষেত্রে সামর্থ্য আছে বা নেই সেটা না জেনেই কেউ কেউ order একটা দিয়ে দেন। সদ্‌গুরুরা নিজের দিকে টেনে আনেন, সরিয়ে দেন না। তাঁরা সত্তার সঙ্গে মিশে আছেন। তাঁরা সকলকে সত্তার দিকে টেনে আনতে চাইছেন, তাই তাঁরা আকর্ষণ করেন। জাগতিক পর্যায়ে human plane-এ গুরু শিষ্যকে একীভূত করার জন্য আকর্ষণ করেন না। তাঁরা সর্বদাই একটা difference maintain করেই চলেন।[/read]

Capture

ঋষিযুগে সত্যের অনুশাসন পদ্ধতি –

গুরু অর্থ Universal; সীমাবদ্ধ করলেই লঘু। গুরু হল অনন্ত-অসীমের ideal অর্থাৎ মূর্তবিগ্রহ।
মনে যখন যে রূপ উপস্থিত হয় সবই তাঁর রূপ বলে গ্রহণ করলে মন সহজেই বোধময় সত্তায় রূপায়িত হয়ে যায়। বোধময় সত্তা কেবল জ্ঞানমূর্তি, আত্মার যথার্থ স্বরূপ, ব্রহ্মস্বরূপ বা ইষ্টগুরু মাতার স্বরূপ।

Capture

গুরু-শিষ্যের সম্বন্ধ –

গুরুকে সর্বদা সঙ্গে পেলে আর কাউকেই ভয় হয় না। যে গুরু পূর্ণ জ্ঞানের বিশ্বাসটি ধরিয়ে দিতে পারেন, তিনিই হলেন সদ্‌গুরু। এই রকম জ্ঞানকেই জ্ঞানাঞ্জনশলাকা বলা হয়েছে। গুরুর দায়িত্ব কম নয়। শিষ্যেকে মুক্ত না করা পর্যন্ত গুরুর দায়িত্বভার শেষ হয় না।।

Capture

গুরুর ভিন্ন ভিন্ন পরিচয় –

গুরু ঈশ্বর দ্বারাই appointed হয়ে আসেন। সংসারে যাঁরা পথভ্রষ্ট হয়েছেন তাঁদের পথের সন্ধান দিয়ে দেন তাঁরা। যেমন মেলা শেষ হয়ে যাবার পরেও ভলান্টিয়ারদের কাজ শেষ হয় না। যারা পথ হারিয়ে ফেলে, মা বাবার কাছ থেকে বিছিন্ন হয়ে পড়ে, ভীড়ের মধ্যে তাদের খুঁজে মা-বাবার কাছে ফিরিয়ে দেওয়া প্রভৃতি কাজ থাকে। সেইরকম গুরুদেরও কাজ থাকে। তাঁরা নিজের মুক্তির কথা না ভেবে অপরকে মুক্তির সন্ধান দেন। গুরু হলেন স্বয়ং ভগবান। প্রত্যেকের greater part-এর নামই গুরু। স্বিং ঈশ্বর সেখানে কাজ করেন। গুরুকে মনুষ্যবুদ্ধিতে নিতে নেই। মানুষের রূপে এসে গুরু সকলকে পথ দেখিয়ে দেন।

Capture

গুরুর প্রয়োজনীয়তা –

গুরুর ওপর সব দোষ না চাপিয়ে নিজেকেই সঁপে দিতে হয় গুরুর কাছে। যখনই যা কিছু প্রকাশ হয় তাকেই – ‘ইহাও তুমি’ – এইটুকু ভাবা হল মন দিয়ে দেওয়া। অংশমাত্র তাঁকে না দিয়ে পরিপূর্ণভাবে চিতিমাতা বা গুরুকে সঁপে দিতে হয়। তাহলেই ‘আমি আমার’ ভাব অর্থাৎ অহংকার দূর হয়ে যায়।

Capture

গুরুকে যথার্থভাবে মানা হলেই সবকিছুর সমাধান হয়ে যায় –

গুরুকে যথার্থভাবে মানা হলে বহু আর থাকে না। সব শব্দ-বোধ-নাম-রূপের মধ্যেই তখন গুরুকে অনুভব হবে। তা যদি না হয় তবে বুঝতে হবে গুরুকে মানা হয়নি। মা, গুরু, আত্মা, ইষ্ট, ব্রহ্ম, হরি যার যা খুশি সে তা-ই বলতে পারে। সবই এক অর্থবোধক।

Capture

সদ্‌গুরুর মাহাত্ম্য –

সদ্‌গুরুর দায়িত্ব অনেক। যাঁদের অতখানি দায়িত্ববোধ থাকে না তাঁরা সদ্‌গুরুর পর্যায়ের নন। শিষ্যের দুর্গতিতে তাঁরা বলেন – আমি কী করব? তোমার নিজের কর্মদোষে তুমি ভুগছ। আর সদ্‌গুরু কিন্তু ভোগটা নিজেরা নেন। সাধারণ গুরু credit নেয় শুধু, কিন্তু ভোগ নেয় না। আর সদ্‌গুরু credit নেন না, কিন্তু দুর্ভোগটা নিজেরা টেনে নেন।[read more=”Read More…” less=”Read less”]সদ্‌গুরু অনেক সময় প্রয়োজনমত কঠোর ব্যবহার করলেও অন্তরের স্নেহঘন দৃষ্টি দিয়ে শিষ্যদের ঘিরে রাখেন। গুরু বা চিদানন্দময়ী মা যদি চলার পথে সাহায্য না করেন, তবে দুঃখ-কষ্টের আর সীমা থাকে না। ‘তিনি সর্বদা আমাদের মধ্যে আছেন এবং আমি তাঁর মধ্যে আছি’ – এই হল সর্ব সাধনার শেষ কথা। এই বিশ্বাস নিয়ে যদি সাধনা আরম্ভ করা হয় তবে চরমতম অবস্থায় পৌঁছানো অনেক সহজ হয়। সাধনা গুরুই, শিষ্যের কোন ক্ষমতাই নেই। শিষ্যের জন্য ভাবনাচিন্তা গুরুই করেন। তিনিই তার কল্যাণ করেন। আথচ মানুষ অহংকার ও অভিমান বশত সহজে তাঁকে accept করতে পারে না। সর্বত্র রাম বা আত্মারাম ছাড়া আর কিছুই নেই। সেই আত্মারামই বিশ্বের সব কিছু হয়ে রয়েছেন। রাম, ইষ্ট, গুরু, মা সব একজনকেই বলা হয়। গুরু বা মা যা শিখিয়ে দেন তা যদি না মেনে চলা হয় তবে দুঃখ-কষ্টও কমে না।[/read]

Capture

বিজ্ঞানঘন গুরুর রূপ –

গুরুমুখে শাস্ত্রকথা শুনতে হয়। গ্রন্থের সঙ্গ করলে গ্রন্থিই বেড়ে যায়। গুরু সঙ্গে না থাকলে যোগযুক্ত কেউ হতে পারে না; ভক্তি আসতে পারে না। সত্য হল একের বিজ্ঞান, একের অনুভব ও একে থাকার নাম। বার বার শুনতে হয় এই সত্যের কথা। গুরুবরণ যারা করেছে এবং গুরুসঙ্গ যারা করে তাদের শাস্ত্র পড়ার প্রয়োজন হয় না। গুরুকে পরিপূর্ণভাবে বিশ্বাস ও তাঁর ওপর পরিপূর্ণ নির্ভর করলেই উপকার পাওয়া যায়। গুরুকে অখণ্ড বোধে গ্রহণ করতে হয়, তা না হলে দোষদৃষ্টি এসে যায়। কারোর ওপর দোষদৃষ্টি এসে গেলে গুরুকে আঘাত করা হয়। কারণ গুরু হলেন অখণ্ড বোধমূর্তি।

Capture

গুরুর মহিমা দৃষ্টান্তসহ –

গুরুর যে বিরাট মহিমা তা বলে শেষ করা যায় না। গুরুর মহিমা সম্বন্ধে একটি গল্প বলছি, শোন –
এক ভক্ত নিষ্ঠাসহকারে প্রাণ দিয়ে তাঁর গুরুকে সেবা করত। কিন্তু ভক্তের আয়ু শেষ হয়ে গেলে যমদূত তাকে নিতে আসে। ভক্ত বুঝতে পেরে অনবরত গুরুবন্দনা করতে থাকে। ভক্ত গুরুবন্দনায় রত থাকা অবস্থাতেই যমদূত তাকে যমের কাছে ধরে নিয়ে এসেছে। জম তাকে দেখে চমকে উঠলেন। তাঁর দূতকে তিনি বললেন – “এ তুমি কী করেছ? যে গুরুবন্দনা করছে তাকে তুমি কেন আনলে?” এই বলে যমও তার সঙ্গে গুরুবন্দনা শুরু করে দিলেন, কারণ গুরু একজনই।
গুরুবন্দনার রহস্য হল যে একজন যদি গুরুবন্দনা করে তবে সঙ্গে সঙ্গে যারা গুরুবরণ করেছে তাদেরও গুরুবন্দনা করতে হয়। নয়তো গুরুর প্রতি অশ্রদ্ধা প্রকাশ করা হয়।[read more=”Read More…” less=”Read less”]যম খুব বিপদে পড়ে গেলেন। এদিকে লোকটির আয়ুও শেষ হয়ে গেছে, সুতরাং তাকে নিতেই হবে। আবার ওদিকে সে এমনভাবে গুরুবন্দনা করে চলেছে যে তাকে তিনি ছুঁতেও পারছেন না। আবার, যদি তাকে আয়ু দিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয় সংসারে, তাহলেও তাকে ভূত ভেবে সমাজে আত্মীয়-পরিজনেরা কেউ গ্রহণ করতে পারবে না।
নিরুপায় হয়ে তিনি তখন বিষ্ণুর কাছে গেলেন পরামর্শ নিতে এবং সাহায্য চাইতে। বিষ্ণু বললেন – “আমি তো কিছুই করতে পারব না, কারণ আমিই তো জগতে গুরুবাদ রেখে এসেছি। সেটি তো তাহলে অপবাদে পরিণত হবে। আমি নিজেও তো সেই এক গুরুকেই বন্দনা করছি”।
বিষ্ণু কোন উপায় না দেখে তাঁর গুরু মহেশ্বরকে অহ্বান করলেন। মহেশ্বর বিষ্ণুর কাছে উপস্থিত হয়েই গুরুবন্দনা শুরু করলেন। বিষ্ণুও তাঁর গুরু মহেশ্বরকে বন্দনা করতে লাগলেন…।
বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের প্রবর্তিত নিয়ম সবকিছুই রয়েছে এই গল্পটির মধ্যে। এই গল্পটি তোমরা সবাই মনে রাখবে। এই নিয়মগুলি এতই তাৎপর্যপূর্ণ যে ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বরও break করতে পারেন না।
গুরু শুধু ব্যক্তি নয় এবং নাম-রূপ বা ভাবও নয় তিনি বিশুদ্ধবোধের বিগ্রহ। ভিন্ন ভিন্ন নামে এই এক গুরুকেই আমরা সকলে সেবা করে যাচ্ছি। এই গুরুকেই ইষ্ট, মা, আত্মা, ব্রহ্ম বা ভগবান বলে কেউ, আবার কেউ বলে রাম বা কৃষ্ণ। গুরু মানে great, প্রতিটি development এই গুরু করছেন। অথচ তাঁর কাছ থেকে পেয়েও সবাই তাঁকেই অবজ্ঞা করে। গুরু হলেন অখণ্ড সত্তা, শক্তি, জ্ঞান, আনন্দ ও প্রেম। এই গুরুর কাছ থেকেই সবাই সব কিছু পায়। ভক্ত সেজন্য কারোকে অবজ্ঞা করে না। সে নিজে সব সহ্য করে কিন্তু অপরের দোষত্রুটি দেখে না। গুরুতত্ত্ব শুনতে শুনতেই গুরুময়, গুরুচিত্ত, গুরুপরায়ণ, গুরুগতপ্রাণ হয়ে যায়। ইয়া প্রথমেই হয় না। বহুবার শুনতে শুনতে একবার হয়ে যাবে।
জখানে বিরুদ্ধ অবস্থা, প্রতিকূল অবস্থা সেখানে গুরু বা মাকে বসালে মন আপনিই সংযত হয়। প্রতিকূল অবস্থাও ধীরে ধীরে অপসারিত হয়।
গুরুসঙ্গ না করে ভগবানের সন্ধান করতে গেলে অন্ধকারে ডুবে যেতে হয়। গুরুসঙ্গ করে যে ভগবানের সন্ধান করতে যায় আচিরেই গুরু তার ইষ্টের সঙ্গে মিলন ঘটিয়ে দেন।[/read]

Capture

সদ্‌গুরুই স্বয়ং ভগবান

সদ্‌গুরু ও ভগবানে কোন পার্থক্য নেই। সদ্‌গুরু ভগবান স্বয়ং। তিনিই ঈশ্বরের সঙ্গে যুক্ত করে দেন। যে কোন সদ্‌গুরুর মূর্তি একটুও স্মরণ রাখতে পারলে মানুষ বিপদে আপদে রক্ষা পায়। তাঁরা সর্বদাই বর্তমান। তাঁদের সঙ্গে শুধু একটু বোধের যোগাযোগ রাখতে হয়। দেহ ত্যাগ করে যাবার পড়ে তাঁরা আরো বেশি কাজ করতে পারেন। Spirit can do more finction without his physical body. তাঁদের যে কোন স্থানে বসে অনুভব করা যায়। সীমার বাঁধন নেই তাঁদের, তাই সর্বত্র তাঁরা মিশে আছেন।
ঈশ্বর বা সদ্‌গুরু ছাড়া পরমতত্ত্বে আর কেউ পৌঁছে দিতে পারেন না। সদ্‌গুরু স্থূলে-সূক্ষ্মে-কারণে-মহাকারণে। তিনি সর্বব্যাপী, সর্বজ্ঞ, সর্বধারী। তাঁর অনন্ত পরিচয়, তাই তাঁকেই আবার মাতা বলা হয়। তিনি তিনটি department চালান স্থূল, সূক্ষ্ম ও কারণ বা তমঃ, রজঃ ও সত্ত্বগুণ। যিনি এসব ব্যবহার করেছেন তাঁর সাহায্য ছাড়া এসব কিছুতেই পায়া যায় না। গুরু, আত্মা, ঈশ্বর বা চিদানন্দময়ী মা প্রত্যেকের ভিতরে রয়েছেন। তাঁর কৃপা না হলে কেউ কোন কিছুই পেরে পারে না।

Capture

সদ্‌গুরুমুখে পুনঃপুনঃ শ্রবণের ফলে চিত্তশুদ্ধি হয়

পূর্ণ এক আমির equibalanced nature সব কিছুর মধ্যে থেকেও সমান। গুরুরূপী ইষ্ট তা প্রকাশ না করলে ইহা কখনো প্রকাশিত হওয়ার উপায় নেই। গুরুর স্থান তাই হৃদয়ে। গুরুকে অন্তরে হৃদয়ে মেনো সবাই। তাঁকে কেউ আঘাত করো না চাওয়া দিয়ে ভেদবুদ্ধি করে।
গুরুকে বা মাকে ভোগ করা যায় না। গুরুকে, মাকে ভোগ দাও, তবে তো ভোগ কাটবে। বলতে হয় – আমার অন্তরে বসে তুমি খাও, তুমি দেখ, তুমি কর।
সৎসঙ্গে বা গুরুমুখে পুনঃপুনঃ ঈশ্বরপ্রসঙ্গ শুনতে হয়। বারবার শুনতে শুনতে একবার হয়ে যাবে। কাঁচের গ্লাশের মধ্যে ময়লা জল আছে; তখন যদি ওপর থেকে অনবরত পরিষ্কার জল ঢালতে থাক, তবে কিছুক্ষণ পরে দেখা যাবে ময়লা জলটা বেরিয়ে গিয়ে পরিষ্কার নির্মল জলে পূর্ণ হয়ে গেছে গ্লাশটি। সেইরূপ সৎসঙ্গে বা গুরুমুখে পুনঃপুনঃ শুনতে শুনতে অন্তরের পূর্বসঞ্চিত বাজে সংস্কারগুলি চলে যায় এবং ঈশ্বর প্রসঙ্গ বা তাঁর মহিমা দ্বারাই মন পূর্ণ হয়। সৎসঙ্গে সাধুমুখে শ্রবণের মাধ্যমে সৎ যে কীভাবে ভিতরে infused হয়ে যায় তা পূর্বে বোঝা যায় না। এগুলি পরে জেগে উঠবেই।[read more=”Read More…” less=”Read less”]বোধের গুরু ও গুরুর বোধ, ভগবানের আমি ও আমার ভগবান – এই উভয়ের মধ্যে পার্থক্য আছে। অগ্রভাগে তাঁকে রাখতে হয়। ‘আমার মা’ না বলে ‘মায়ের আমি’ বলতে হয়। মন্নাথ শ্রীজগন্নাত বা মদ্‌গুরু শ্রীজগদ্‌গুরু না বলে শ্রীজগন্নাথ মন্নাথ বা শ্রীজগদ্‌গুরু মদ্‌গুরু বললে অনেক গুরু বা অনেক নাথ আর থাকে না। তখন এক নাথই সকলের নাথ এবং এক গুরুই সকলের গুরুরূপে আবির্ভূত হন।
সদ্‌গুরু হলেন অখণ্ডের দ্বার ও কেন্দ্র সত্তা উভয়ই, কেবল ব্যক্তিবিশেষ নয়। গুরু, মা, ইষ্ট একজনকেই বলা হয়। তাঁকে ধরে তবে ‘অখণ্ডের আমি’-তে পৌঁছাতে হবে। সব সাধনার লক্ষ্যই হল সেই অখণ্ড আমিতে পৌঁছানো বা অখন্দএকে প্রতিষ্ঠিত হওয়া।
গুরু, ইষ্ট, মা বলে তাঁর ওপর সমস্ত কর্তৃত্ব ভার ও ব্যক্তিগত স্বার্থ সব ধীরে ধীরে ছাড়তে হবে। তাহলেই আস্তে আস্তে নিজে free হওয়া যায়। বড় বা গুরুর সঙ্গ করে তাঁকে আপন করতে হয়, তারপরে গুরু বা ইষ্টকে সব কিছুর মধ্যে বসিয়ে তাঁর ওপর নির্ভর করতে হয়।[/read]

Capture

*স্বানুভবসিদ্ধ গুরুই শিষ্যকে আত্মজ্ঞান লাভে সহায়তা করতে পারেন –

এক উচ্চকোটি মহাত্মা ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষের এক আশ্রিত সন্তান ছিল এবং তার খুব অহংকার অভিমানও ছিল। কিন্তু মহাত্মার কাছে এসে মহাত্মার ছোট ছোট কথায় খুব অবাক হয়ে যায় সে। ভাবে যে মহাত্মার কত পড়াশুনা, কত জ্ঞান যে to the point সব উত্তর দিয়ে দেন চটপট।[read more=”Read More…” less=”Read less”]কিন্তু গুরুর কাছে থেকেও গুরুকে যতটা মর্যাদা দেওয়া উচিত ততটা মর্যাদা সে দেয় না। ধ্যানে ঠিকমত মনও দিতে পারে না কারণ মন তার অতি চঞ্চল ও অস্থির। কখনো কখনো সে তার অশ্রদ্ধার ভাবটিও প্রকাশ করে ফেলত।
গুরু তাকে একদিন বললেন – “আমি তো তোমার কাছে যাইনি; তুমিই এসেছ আমার কাছে তোমার বিকার, অস্থিরতা ও চঞ্চলতা দূর করার জন্য। কিন্তু আজ তুমি সে কথা ভুলে গেছ, তুমি মনে ভেবো না যে আমি এসব তোমাকে দিতে বাধ্য। যে লোক যথার্থভাবে গ্রহণ করবে তাকেই আমি সব দেব। আমি ফুটো পাত্রে জল ঢালব না বা যার পকেট ছেঁড়া সেই পকেটে টাকা দেব না। যে চৌবাচ্চায় জল বেরিয়ে যায় তাতে আমি কেন জল ঢালব।
“তোমার যদি এখানে সুবিধা না হয় তবে তুমি অন্যত্র যেতেও পার। তবে আমি জানি কোথায় তোমার সুতো বাঁধা আছে। যেখানেই যাও, ফিরে আবার আমার কাছেই আসতেই হবে। তবে মনে রেখো তখন তোমার আরো কঠোর মূল্য দিয়ে সব গ্রহণ করতে হবে…”।
মহাপুরুষেরা যতখানি নরম ততখানি শক্ত। করুণার্দ্র হৃদয় যখন বজ্রকঠিন হয়, একবিন্দু করুণা আর আদায় করা যায় না। সন্তানের ওপর মা-বাবা যখন বিগড়ে যান, তখন টাকাপয়সা স্মপত্তি অন্য কারোকে দেন, সন্তানকে দেন না। তখন শত কান্নাকাটি করেও বাবার মন গলাতে পারে না।[/read]

Capture

গুরুদত্ত বীজের সাহায্যেই জীবনে পূর্ণতা লাভ হয় –

গুরু বীজ যা দেন তাতে মন রাখলে মন স্থির হয়ে যায়। ‘গুরুদত্ত বীজ না করে সাধন/পূর্ণ হবে কী করে জীবন?’ বীজ হল seed of Consciousness. বীজ থেকেই প্রাণ অঙ্কুরিত হয়ে প্রাণময় হয়ে উঠবে। নাম না জানলে শৈশব থেকে যে ‘মা’ না উচ্চারণ করে এসেছ তাই কর। রূপের ভাবনা করতে হলেও তাঁকেই ভাব। পড়ে গুরুর কাছে বীজমন্ত্র নেবার পর গুরুই বলে দেবেন যে গর্ভধারিণী মায়ের চাইতেও বড় রূপ আছে। আরো বড়র দিকে এগোতে এগোতে সব রূপের সমাধান হয়ে অরূপ খাওয়া যায়। নাম গুরু, শিবও হলেন গুরু যিনি নামেতে রত। ঈশ্বরের নাম একমাত্র শিব জানেন, যিনি জ্ঞানঘন। জ্ঞানই অজ্ঞান বা বহুকে তাড়াতে পারেন। গুরুর সাহায্য না হলে কিছুতেই অগ্রসর হওয়া যায় না। গুরু বা বিশ্বচৈতন্য অখণ্ড জ্ঞানস্বরূপ, সচ্চিদানন্দস্বরূপ। স্বয়ংপ্রকাশ। তাঁর অভিব্যক্তি হয় নামে। কোন সত্য বস্তুর পরিচয় নাম ছাড়া হয় না। ভগবানের নাম যখন তখন যে কেউ নিতে পারে। ইহাই হল দীক্ষা। তিনি নিত্য বিদ্যমান। নামকে ধরা হলে তাঁকেই ধরা হল।

Capture

দীক্ষার বভিন্ন ধারা –

অখণ্ড সত্যকেই গুরুমূর্তি হিসাবে গ্রহণ করবে। সদ্‌গুরু কখনো ব্যক্তিবিশেষের রূপ গ্রহণ করতে বলেন না। তাঁরা বলেন – আমি সর্বত্রই আছি, সব রূপেতেই আছি।

Capture

যথার্থ সদ্‌গুরুর লক্ষণ –

গুরু যিনি তিনি নিজেকে রক্ষা করতে যেমন জানেনে সেইরকম আশ্রিতকেও রক্ষা করতে পারেন। Common বোধ যেটা সেই একমাত্র সকল অবস্থার মধ্যে এগিয়ে যেতে সাহায্য করবে।
গুরু হল বিশুদ্ধ জ্ঞানদেহ, ত্রিবেদী- সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ এবং তিন কালকেও যিনি জানেন, ত্রিস্বর্গ, ত্রিভুবনকেও যিনি জানেন এবং যাঁর একটিমাত্র বোধ।
একের দৃষ্টি, একে স্থিতি ও একনীতি যাঁর থাকে তিনিই সত্যিকারের গুরু। এই গুরুর সঙ্গে যুক্ত হলে তবে সত্যের পথে এগোন যাবে। নিজের ইচ্ছানুযায়ী নিজের ইচ্ছামত চললে অর্জুন যুদ্ধে আর জয়লাভ করতে পারত না। শ্রীকৃষ্ণ হলেন যথার্থ সদ্‌গুরু। যিনি ভাল-মন্দ। সুখ-দুঃখ সকল অবস্থাতেই এগিয়ে নিয়ে যাবেন তিনিই গুরু হওয়ার উপযুক্ত।

Capture

জীবনে উন্নতি লাভের জন্য তীব্র ব্যাকুলতা ও নিষ্ঠার একান্ত প্রয়োজন..গল্পে উদাহরণ –

গুরুর প্রতি নিষ্ঠা ও ভক্তির প্রসঙ্গে তোমাদের আরেকটি গল্প বলছি –
এক মহাপুরুষ তাঁর শিষ্যেদের গুরুভক্তি পরীক্ষার ইচ্ছা করলেন। সাতদিন তিনি ঘরে বন্ধ রইলেন। দরজা একেবারে বন্ধ, কারোর সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করলেন না। সাতদিন পরে ঘর থেকে বেরোলেন, পায়ে একটা ব্যান্ডেজ বাঁধা।
শিষ্যরা উৎকণ্ঠার সঙ্গে জিজ্ঞাস করল – “গুরুদেব আপনার পায়ে কী হয়েছে?”
গুরুদেব – “খুব যন্ত্রণাদায়ক একটি ফোঁড়া হয়েছে। খুব বিষাক্ত হয়ে গেছে ফোঁড়াটা”।[read more=”Read More…” less=”Read less”]শিষ্যরা সকলেই তাঁর সেবাযত্ন করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ল। কেউ কেউ operation করার জন্য অনুরোধ করল। কিন্তু গুরুদেব operation বা অন্য কোন চিকিৎসা করাতে রাজি হলেন না।
শিষ্যরা বলল – “তাহলে কী উপায় হবে? কীভাবে আরাম হতে পারে তবে?”
গুরুদেব – “একটিমাত্র উপায় আছে, কিন্তু সেটিও সম্ভব নয়। কারণ ফোঁড়াটা খুবই বিষাক্ত হয়ে গেছে। কেউ যদি মুখ দিয়ে চুষে এর বিষটা টেনে বার করে নেয় তবেই একমাত্র আরাম হওয়ার উপায় আছে”।
একথা শুনে শিষ্যরা ধীরে ধীরে একে একে সেখান থেকে সরে গেল। গুরুদেব এসব দেখেশুনে মনে মনে হাসলেন। এর মধ্যে এক রাখাল বালক জানতে পারল যে গুরুদেবের খুব অসুখ – পায়ে ফোঁড়া হওয়াতে খুব কষ্ট পাচ্ছেন। ছেলেটি একসময়ে গুরুদেবের কাছে খুব স্নেহ-কৃপা, ভালবাসা পেয়েছিল। যখনই সে আশ্রমে আসত গুরুদেব তাকে প্রসাদ দিতেন, মাথায় গায়ে একটু হাত বুলিয়ে দিতেন। সেই থেকেই ছেলেটি তাঁকে খুব শ্রদ্ধাভক্তি করত।
রাখাল ছেলেটি শিষ্যদের কাছে আরো শুনল যে ফোঁড়াটি খুব বিষাক্ত হয়ে গেছে, কেউ যদি মুখ দিয়ে চুষে ফোঁড়াটার বিষাক্ত পুঁজরক্ত ফেলে দিতে পারে তবে গুরুদেব সেরে উঠবেন।
পরদিন সেই রাখাল ছেলেটি অতি সংকোচের সঙ্গে গুরুদেবের কাছে এসে জানাল যে সে গুরুদেবের ফোঁড়াটা চুষে তার বিষাক্ত পুঁজরক্ত বার করে দেবে। গুরুদেব প্রথমে খুব আপত্তি করলেন এবং বললেন যে তাতে ছেলেটির জীবন বিপন্ন হবার খুব সম্ভাবনা আছে। কিন্তু ছেলেটি তাঁর কোন কথাই শুনতে চাইল না। সে ছলছল চোখে দাঁড়িয়ে রইল গুরুদেবের এই সেবাটুকু করার জন্য।
সে বলল – “আমি গরিব ঘরে জন্মেছি। আমার জীবনের কী আর মূল্য আছে? কিন্তু আপনি বেঁচে থাকলে কত লোকের কল্যাণ হবে, উপকার হবে”।
গুরুদেব বললেন – “বেশ, তাই হবে”।
আসল রহস্য হল গুরুদেব শিষ্যদের পরীক্ষা করার জন্য একটা পাকা ফল হাঁটুতে বেঁধে রেখেছিলেন এবং বলতেন ফোঁড়া হয়েছে। সেই পাকা ফলের রস গড়িয়ে পড়ছিল, রাখাল ছেলে সেটাই চুষে খেয়ে নিল।
কিছুদিন পরে রাখাল ছেলেটি মারা গেলে মহাপুরুষ নিজেই তার সৎকার করলেন ও বললেন – “আমার মধ্যে যা কিছু ঈশ্বরীয় প্রকাশ সে সব কিছুই এই ছেলেটি আবার যখন জন্ম নেবে তখন তার মধ্যে প্রকাশ পাবে। এর পরের জন্মে পূর্ণ ঈশ্বরীয় ভাব নিয়ে সে জন্মগ্রহণ করবে”।
এই নিষ্ঠা, ভক্তি, আত্মদানই হল ঈশ্বরলাভের একমাত্র পাথেয়। যারা অবিশ্বাসী, ঈশ্বরবিরোধী তাদের দুঃখকষ্ট অনন্ত, যারা বিশ্বাসী তাদের দুঃখকষ্ট কম যায়। ঈশ্বরের দিকে লক্ষ্য থাকলে, মহতের দিকে দৃষ্টি থাকলে কেউ দুঃখকষ্টকে পরোয়া করে না। Supreme ideal হল God, কাজেই তাঁকে সামনে রেখে চললে অন্যদিকে দৃষ্টি আসে না।
গুরু হলেন embodiment of Pure Consciousness । গুরু, বোধ বা মহৎ এক অর্থবোধক। যা দিয়ে ‘গুরু’ শব্দতি ব্যবহার করা হয় তা-ই হল বোধ। বোধ দিয়েই বোধকে ব্যবহার করা হচ্ছে। ইহাই হল বোধের সঙ্গে বোধের খেলা।[/read]

Capture

শিষ্য কোন গুরুতর অপরাধ করলেও গুরু তাকে পরিত্যাগ না করে উপযুক্ত করে তোলেন..গল্পে উদাহরণ –

মা বা গুরু হলেন মধ্যম পুরুষ যাঁকে ‘তুমি-তুমি’ বলা হয়। তাঁর সাহায্যেই কেন্দ্রে বা প্রজ্ঞানে যেতে হবে। বাড়ির একেবারে অন্দরমহলে যেতে হলে যেমন প্রহরী, দারোয়ান বা দ্বারীর সাহায্যে যেতে হয়। জ্ঞানকে তাই দ্বারী বা প্রহরী বলা হয়। অজ্ঞানের কাজ হল ভুলিয়ে দেওয়া। জ্ঞান না হলে, জ্ঞানের অনুমতি না পেলে প্রজ্ঞানে যাওয়া যায় না। Inner Consciousness-এর সাহায্য না নেওয়া হলে অজ্ঞান দখল করে নেবে। গুরুও অন্তরের জ্ঞান দেন প্রথমে। তারপর তাঁর নয়নে নয়ন রেখে চলতে থাকলে দৃষ্টিভঙ্গি সব পালটে যায়। তারপর সেই জ্ঞান দিয়ে প্রজ্ঞানের সঙ্গে মিশে যায়।
তোমাদের কিছু reject করার কথা কখনো যেন কারো মনে না আসে, তা বস্তুই হোক বা ব্যক্তিই হোক। তার মধ্যে ঈশ্বরকে বসিয়ে ব্যবহার করতে হবে। তাহলে তোমাদের মধ্যেও ঈশ্বরের প্রভাব আসবে এবং তোমাদের সংস্পর্শে যে আসবে তার মধ্যেও ঈশ্বরের প্রভাব আসবে।[read more=”Read More…” less=”Read less”]এক গুরুর আশ্রমে কয়েকজন শিষ্য থাকে। গুরু তাদের সবাইকে সমানভাবে সুন্দর করে শিক্ষা দেন। তাদের মধ্যে একদিন একটি নূতন ছেলে এল – ভারী সুন্দর, নম্র ও ভদ্র। গুরু তাকে যখন যা বলেন খুব শ্রদ্ধার সঙ্গে সে তা শোনে ও পালন করে। গুরুদেব সেজন্য তাকে খুব স্নেহ করেন। নূতন ছেলেটিকে দেখে অন্যান্য শিষ্যদের মধ্যে কারো কারো বেশ হিংসার ভাব এল। তাদের মনোভাব হল – কোথা থেকে এক নূতন ছেলে এসে গুরুদেবের মনটা জয় করে নিল।
একদিন গুরুদেব বিশেষ একটা কাজের ভার দিয়ে পুরনো শিষ্যদের মধ্যে একজনকে পাশের গ্রামে পাঠালেন এবং সেই সঙ্গে বলে দিলেন যে, নূতন যে ছেলেটি কয়েকদিন আগে আশ্রমে এসেছে তার মা-বাবার পাশের গ্রামেই থাকেন। কাজে যাবার সময় সে যেন তার মা বাবাকে জানিয়ে যায় যে তাঁদের ছেলে ভালই আছে – কোন চিন্তা যেন না করেন।
পুরনো শিষ্যটি তো গুরুর দেওয়া কার্যভার নিয়ে চলে গেল। নূতন ছোট শিষ্যটির ওপর তার খুব হিংসা ভাব ছিল। সে ভাবল আবার একটা কৌশলে ওকে এবং ওর মা বাবাকে খুব জব্দ করবে। এই ভেবে পাশের গ্রামে গিয়ে নূতন ছেলেটির মা বাবার কাছে উপস্থিত হল এবং খুব বিষাদগ্রস্ত হবার ভান করে তাঁদের বলল যে তার গুরুদেব তাকে পাঠিয়েছেন একটা দুঃসংবাদ দেবার জন্য। দুঃসংবাদটি হল যে তাঁদের ছেলেটি সেদিন সকালেই হঠাৎ মারা গিয়েছে।
এই কথা বলামাত্র ছেলেটির মা-বাবা হো হো করে হেসে উঠলেন এবং বললেন, “বাবা, তুমি বোধ হয় তোমার গুরুদেবের কথা শুনতে করেছ। আমরা এমন কোনও পাপ কাজ কখনো করিনি যে পাপের জন্য আমাদের সন্তানের এরকম অকালমৃত্যু হতে পারে”।
Right action-এর ফলে কতখানি convinced হয়ে তাঁরা আছেন তা-ই বোঝা যায় ঘটনাটি থেকে। তাঁদের মনের এরূপ দৃঢ়তা দেখে শিষ্যটি অবাক হয়ে গেল। এদিকে গুরুদেবও সবকিছু বুঝতে পেরেছিলেন।
শিষ্যটি ফিরে এলে গুরুদেব তাকে বললেন – “তুমি বড় ভাই এবং এই নূতন ছেলেটি হতে বড়। তথাপি এই ছোট ছেলেটিকে এত হিংসা কর এ বড় দুঃখের কথা। এই ছোট ছেলেটির সদ্‌গুণগুলি দেখে তোমার আনন্দ হওয়া উচিত, অথচ তার পরিবর্তে তোমার এমন জঘন্য মনোবৃত্তি কী করে হল? আশ্রমে থেকে এত সৎপ্রসঙ্গ শ্রবণ করেও তোমার চরিত্রের একটুও উন্নতি হল না? যাক যা হবার হয়ে গেছে, ভবিষ্যতে আর কখনো এরকম করতে যেও না”।
শিষ্যকে তার গর্হিত কর্মের জন্য তাড়িয়েও দিতে পারতেন; কিন্তু তিনি তা করলেন না। তবে তাকে ডেকে তার সংশোধনের অন্য রকম ব্যবস্থা দিলেন। এতদিন পূজার ঘরে কাজের ভার তার ওপর ছিল; কিন্তু এই গর্হিত কাজের জন্য তাকে আবার গোয়ালঘরের কাজে নিযুক্ত করলেন।[/read]

Capture

গুরুর মর্মার্থ

জ্ঞান হল গুরু। গুরু কোন body নয়। গুরু অর্থ অখণ্ড বোধসত্তা। সে শুধু দিয়েই যায়, চায় না। সে শুধু দেখে যায় কার কতটুকু আগ্রহ। পরমাপ্রকৃতি বা ঈশ্বর একই। তাঁকেই মা বা গুরু বলা হয়। পরমাপ্রকৃতি ও ঈশ্বর অভেদ, যেমন আগুনের দাহিকাশক্তি ও আগুন অভেদ। গুরু মানে বোধের গুরু, গুরুর বোধ নয়।

Capture

আমির বিভিন্ন স্তর

নাম ছাড়া আসল জ্ঞান আসতেই পারে না। নামই ব্রহ্ম, আত্মা, ঈশ্বর, গুরু। গুরু বা মহাপুরুষরা সবাই নাম দেন, কারণ অব্যয় বীজ হল এই নাম। নামের এত বড় প্রভাব যে জ্ঞানী, যোগী, কর্মী, ভক্ত সবাই এই নাম করছে। জ্ঞানী বলে ব্রহ্ম, যোগী বলে আত্মা, ভক্ত বলে ইষ্ট গুরু মা বা হরি, কর্মী তাঁকেই বলে গুরু। কিন্তু সবাই নামই করেন।
গুরুদত্ত বীজে সবই রয়েছে। বীজরূপে তিনি অণোরণীয়ান, আবার মহতোমহীয়ানও তিনিই। বীজকে না ধরলে মহতোমহীয়ানকে পাওয়া যায় না।[read more=”Read More…” less=”Read less”]গুরু শুধু একটা নাম বা রূপ নয়। তিনি মহান অনন্ত অসীম বোধসত্তা। অথবা তাঁকে বলা চলে door of Infinite। অন্ধকার নিশীথে চলতে গেলে beacon light ও lighthouse-এর আলো দরকার। ইহা পাওয়া যায় গুরুর কাছ থেকেই।
আমাদের অন্তরে বাইরে সর্বত্রই গুরু বা মা। Divinity is speaking, Divinity is hearing । সুখে থাকতে পারলে বা ভাল থাকতে পারলেই যেন গুরুভক্তি। কিন্তু যেই বিপদ এল বা দুঃখ ঘনিয়ে এল অম্নি গুরুভক্তি চলে গেল। ইহা গুরুভক্তির লক্ষণ নয়। সর্বদা স্মরণে রাখতে হবে সুখ-দুঃখ, ভাল-মন্দ যাই আসুক সবই গুরুমূর্তি। দুঃখরূপে তিনি এসে তোমাকে সচেতন করে বোধ দিয়ে যান, অভিজ্ঞতা দিয়ে যান। গুরু হলেন দুঃখমূর্তি। তাই তো দেখা যায় শিবের দুঃখমূর্তি। ভোগবিলাসের চিহ্ন মাত্র নেই।[/read]

Capture

দুঃখকে পরিহার করার চেষ্টা না করে বরণ করে নেবার শিক্ষা

জীবের শিবত্ব এনে দেন গুরু বা মা। আমাদের দেশে ‘মা’ বলে সাধকরা তাই এত কান্নাকাটি করে। ‘মা’ এই বোধ হৃদয়কে শুদ্ধ করে, পবিত্র করে। ‘আমার বোধ’ বিলীন করতে হলে মা বা গুরুই সবচেয়ে বড় সহায়ক। মা-ই গুরু এবং গুরুই মা। তিনি সকলের অন্তরেই রয়েছেন।

Capture

সৎসঙ্গের প্রভাবে জীবনে কীভাবে পরিবর্তন আসে তার একটি দৃষ্টান্ত –

জীবের আসল গুরু জীবের হৃদয় কেন্দ্রেই আছেন – ইহা জীব বুঝতে পারে না বলেই বাইরে form-এর মধ্যে এসে গুরু নিজেই ধরিয়ে দিয়ে যান। গুরু হলেন সচ্চিদানন্দ স্বয়ং। এই প্রকৃত গুরু রয়েছেন within self । বাইরে রূপের গুরু হল এই অন্তরে সচিদানন্দ গুরুর medium, কাজেই যে নামেই ডাকা হোক মনে রাখতে হয় যে সব রূপ, নাম, ভাব ও বোধ একজনেরই। তাহলে আর গোলমাল হয় না। যেকোন নামই নেওয়া হোক নামের সঙ্গে বোধটি যুক্ত করে নিতে হবে।

Capture

বিজ্ঞানময় গুরুর বৈশিষ্ট্য ও তাৎপর্য –

বিজ্ঞানময় গুরু জোর করে কাউকে কখনো ঈশ্বরাভিমুখী করেন না। ওৎ পেসে বসে অপেক্ষা করেন কখন শিষ্য নিজেকে সঁপে দেবে তাঁর কাছে। জোর করতে গেলে friction হয়।

Capture

আদর্শ গুরুর লক্ষণ –

আদর্শ গুরু হলেন শিবতুল্য, অর্থাৎ সম ও শান্তির ঘনীভূত রূপ। শিব হলেন embodiment of the highest truth । সেখানে সব লয় – কিছুই নেই। গুরুমূর্তি নিজের বক্ষে নিজেই টেনে নেবেন। তখন এখানকার সবকিছুই পড়ে থাকবে। গুরু শুধু টানছেন। শূন্য করতে চাইছেন। এই গুরু হলেন নিত্য প্রশান্তস্বরূপ। গুরু হলেন অখণ্ড বোধসত্তা।[read more=”Read More…” less=”Read less”]ময়লা কাপড় জোরে জোরে আছাড় দিলে যেমন তা নষ্ট হয়ে যায়, সেই রকম বেশি তাড়াহুড়ো করলে বা এক সঙ্গে বেশি চাপ দিলে শিষ্যেরও বিকার এসে যায়। সেইজন্য গুরু রাস্তা পরিষ্কার করে শিষ্যকে ধীরে ধীরে টেনে নেন নিজের বক্ষে। গুরু সবচেয়ে ভাল কাজ করতে পারেন রাত্রিতে ঘুমের মধ্যে ও সমাধি অবস্থায়।
গুরু, মহাত্মা, ইষ্ট প্রভৃতি হলেন door to infinity; তাঁদের মধ্য দিয়ে finite Infinite-এর সঙ্গে যুক্ত হয়।
*সত্যিকারের সদ্‌গুরু পাখির ছানার মত শিষ্যকে আগলে রেখে যখন দেখেন যে এইবার আর ফসকে যাবে না তখন তাকে নিজের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দেন। সেই গুরু আজকাল খুব কম। শুনলে অনেকে হয়তো অসন্তুষ্ট হবেন। অসন্তুষ্ট হলে বুঝতে হবে আত্মতত্ত্ব তখন লাভ হয় নি। তার কারণ, কারোর ব্যথা যখন লাগে, তখন ভুলে থাকে তাঁর কথা; ব্যথা যখন অনুভব করে না, তখন ভুলে থাকে নিজের কথা।।[/read]

Capture

সদ্‌গুরুর মহিমা ও বৈশিষ্ট্য –

গুরু কেবল জ্ঞানমূর্তি। নিত্যপূর্ণ, শাশ্বত, সমান উপাদান। ভিন্ন ভিন্ন দেহ মধ্যমে তাঁর অভিব্যক্তি হয়। দেহগুলি হল তাঁর design an pattern । কিন্তু প্রতিটি দেহের উপাদান, সত্তা এক। যেমন এক সোনা দিয়ে ভিন্ন ভিন্ন design pattern-এর গহনা তৈরি হয়…।
Spiritual science ও তার term-গুলি ভিন্ন ভিন্ন জুগে, ভিন্ন ভিন্ন রকম ভাবে লেখা থাকে বইয়ে। কেউ ধরিয়ে না দিলে পরিষ্কার হয় না। ইহা গুরুগত বিদ্যা। যিনি নিঃসংশয়ে তোমাকে দান করবেন, তোমার সংশয় দূর করবেন, তিনিই তোমার গুরু। গুরু তিনিই হতে পারেন, যাঁর ভেদজ্ঞান চলে গেছে এবং যিনি একেতে প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছেন। তিনিই তোমাকে নানাত্ব-বহত্বের প্রভাব থেকে টেনে এনে জ্ঞানটি দিয়ে দিতে পারেন।

Capture

তিনটি পুরুষের পরিচয় –

গুরুকে না মেনে জ্ঞানযোগ, রাজযোগ, ভক্তিযোগ প্রভৃতি কোন পথেই অগ্রসর হওয়া যায় না। কর্মের মধ্যেও গুরুর নির্দেশ না মেনে করলে হয় না। Conductor বা guide একজন দরকার হয়।

Capture

নামসিদ্ধ গুরুর কাছ হতে নাম পেলেই তা ফলপ্রদ হয় –

গুরুর নির্দেশ যথাযথ অনুসরণ করার ফলে গুরুশক্তির প্রকাশ ও বিকাশ সাধকের অন্তরে ব্যাপকভাবে যখন অভিব্যক্ত হয় তখন তার কতগুলি বিশেষ লক্ষণ প্রকাশ পায়। এইরূপ অবস্থায় পরবর্তী স্তরের প্রকাশ-বিকাশের জন্য যা একান্ত প্রয়োজন তা গুরুশক্তি দ্বারাই নিষ্পন্ন হয় এবং পূর্ণসিদ্ধির অন্তরায়গুলিও নিষ্ক্রিয় ও নির্মূল হয়ে যায়। এই ভাবেই চিত্ত মলশূন্য হয়। সাধকের হৃদয় শুদ্ধাভক্তি, বিবেকবৈরাগ্য ও শুদ্ধজ্ঞানের উৎকর্ষ ফুটে ওঠে। তখন ঈশ্বরাত্মার অনুভূতি স্বতঃস্ফূর্ত হয়। ইহা গুরুশক্তিরই পূর্ণাঙ্গ অভিব্যক্তি।

Capture

চতুর্থ গুরুমূর্তির মহিমা –

গুরুতত্ত্ব, গুরুবাদ, গুরুর আদর্শ, গুরুর শিক্ষা, অনুশাসন ও শরণাগতি, অনুভূতি ও জ্ঞান জীবনের পরমলক্ষ্য, পরমগতি ও সিদ্ধি। তদতিরিক্ত আর কিছু শ্রেয়, ধ্যেয় ও জ্ঞেয় নেই।
সদ্‌গুরু বা মহাপুরুষগণ সকলের জন্যই করেন অন্তরে বসে। বাইরের দৃশটিতে তা ধরা পড়ে না। সৎ সর্বদাই একেতে বসে থাকেন। ঈশ্বরের সঙ্গে যুক্ত বলে তাঁরা সকলের সঙ্গেই যুক্ত আছেন।
সদ্‌গুরুগণ সব এক class-এর। তাঁরা শুধু একের কথাই বলেন। সদ্‌গুরু না হলে বহুর কথা থাকে। সদ্‌গুরুদের আগে মধ্যে ও অন্তে শুধু একের কথাই থাকে।

Capture

তিন গুণের শোধন হলেই দেহ শুদ্ধ হয় এবং সমবোধ বা একবোধ প্রতিষ্ঠা হয় –

সদ্‌গুরুদের মধ্যে প্রত্যেক দেবদেবী, ঈশ্বরের প্রত্যেকটি incarnation এসে খেলে যান। প্রভু বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর উক্তিতেই আছে যে মহাপ্রভু বহুবার খেলে গেছেন তাঁর মধ্য দিয়ে। মহাপ্রভু নিজে এসে দীক্ষাও দিয়ে গেছেন। কিন্তু লোক এসব বিশ্বাস করতে চায় না। সত্যি সত্যি যে তাঁকে আপন করে পেতে চায় বা আপন করে নেয় তার মধ্যে সবরকম প্রকাশই হতে বাধ্য।

Capture

সদ্‌গুরুর স্বরূপ ও মহিমা –

গুরু হলেন চৈতন্যস্বরূপ বা চিদ্‌ঘন। গুরু হলেন আত্মস্বরূপ। বাইরের তাঁর দেহ প্রয়জন হয় স্থূল দেহের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার জন্য, কিন্তু তাঁর ভিতরের অংশটি চৈতন্যঘন।
গুরুর আবির্ভাব বহুরূপে হয়। কখনো কর্মশক্তিরূপে, কখনো জ্ঞানরূপে, কখনো গুরুর প্রকাশ আনন্দরূপে। আবার কখনো বা প্রেমের স্বরূপ প্রকাশ হয়। শক্তি প্রকাশ পেলে তাঁর যে জ্ঞান, আনন্দ বা প্রেম নেই তা বলা যায় না। সাধককে গুরুমূর্তি সামনে ধরে রাখতে হয়। গুরুর কর্মশক্তি সাধারণ মানুষের কর্মশক্তি থেকে অনেক বেশি। গুরু প্রেমিক। সাধারণ মানুষের মত কামনা বাসনা তাঁর নেই।[read more=”Read More…” less=”Read less”]গুরু অখণ্ড ভাবে প্রকাশ হতে পারে, আবার খণ্ড খণ্ড ভাবেও প্রকাশ হতে পারে। খণ্ড ভাবে হলেও প্রতিটি প্রকাশে তিনি সমান ভাবেই আছেন। গুরু তাঁর দেহকে ভাগ করে , এমন কি পঁচিশটা ভাগ করেও এক এক রকম ভাবে ব্যবহার করতে পারেন। এই প্রত্যেকটা ভাগে গুরুর সত্তা সমান ভাবেই থাকে। গুরু নিজেকে যত ভাগেই ছড়ান না কেন, সবটার মধ্যেই তাঁকে থাকতে হয়।[/read]

Capture

গুরুই স্বয়ং ব্রহ্ম-আত্মা-ঈশ্বর –

গুরু নিত্য এক। এই গুরুর পরিচয় ভূমা। ভূমার আরেক নাম ব্রহ্ম-আত্মা-ঈশ্বর। ভূমার অন্তর্গত সব প্রকাশ। এ সবই তাঁর। জীবের মধ্যে যে ‘আমার, আমার’ হচ্ছে তা-ও তিনিই করছেন। ‘আমার, আমার বোধে’ তাঁরই খেলা। ইহা জীবের নিজেস্ব নয়।
সদ্‌গুরু বা জগদ্‌গুরু স্নেহদৃষ্টি যে কতখানি তা ভাবাও যায় না। প্রতিনিয়ত তিনি সন্তানের দোষ হজম করে যাচ্ছেন। তাঁর বিশেষত্ব হল তাঁর ‘আপনবোধ’। ‘আপনবধ’-ই হল তাঁর শক্তি। এই শক্তির সাহায্যেই সবকিছু দোষ তিনি হজম করেন। আপনবোধে মিশে গেলে অপর পক্ষের দোষগুলি তাঁর নিজের মধ্যে এসে মিশে যায়। আপনবোধে এসে মিশে যায় দোষগুলি, return আর দেন না। কাজেই দোষ আর বাড়তে পারে না এবং এভাবে দোষগুলি শোধন হয়েও যায়।
মা-বাবা যেমন সন্তানকে না দিয়ে পারেন না, সেইরকম সদ্‌গুরুও শিষ্যকে না দিয়ে পারেন না। মানুষের মত দেহ থাকে তাঁদের তা সত্ত্বেও তাঁরা দেহাতীত ও ইন্দ্রিয়াতীত। স্থূলদেহ নিয়ে তাঁরা কাজ করেন সূক্ষ্মের মধ্যে।

Capture

*ঈশ্বরীয় অভিব্যক্তির জন্য সুস্থ সবল দেহ প্রয়োজন –

গুরু শিষ্যকে কিছু দেবার আগে তার দেহকে উপযুক্ত করে নেন, কারণ তার দেহেন্দ্রিয়ের যদি সামর্থ্য না থাকে তবে তার বিরাট অভিব্যক্তি ধারণ করার শক্তি থাকে না; নড়বড়ে মাচায় ভারি জিনিস রাখলে মাচা যেমন ভেঙ্গে যেতেও পারে। দেহও বড় নড়বড়ে, সামান্য অসুখ-বিসুখ করলে দেহ একেবারে কাহিল হয়ে যায়। সাধু-সন্তরা সইয়ে সইয়ে ধীরে ধীরে দেহ তৈরি করে নেন। সহ্য করা থেকেই শক্তি লাভ হয়।
ব্যামের জন্য যেমন দেহ দরকার, ফুটবল খেলার জন্য যেমন মাঠ দরকার সেই রকম লীলার জন্যও ground দরকার। Ground তইরির জন্য যারা যায় তাদের সদ্‌গুরু তৈরি করে নেন। জোর জবরদস্তি বা তাড়াহুড়ো করে এসব কাজ হয় না। যেসব গুরু তাড়াহুড়ো করে শিষ্যদের কিছু দিতে চায় তাদের দেহ অনেক সময় ভালো করতে গিয়ে নষ্টও করে ফেলে। কোনটার ফল কী হতে পারে এবং কাকে কতটুকু দিতে হবে এসব জানেন তাঁরাই, যাঁরা একের বিজ্ঞানের সাথে পরিচিত।
সাধুদের কাজ হল কারোর দেহ নষ্ট করতে না দেওয়া এবং তাকে অপূর্ণতা থেকে পূর্ণতায় নিয়ে আসা। তাঁরা কারকে নিরাশ করেন না। যদি পঙ্গু হয়ে যায় বা দেহ নষ্ট হয়ে যায় তবে গ্যারান্টি দেওয়া থাকে যে এই জনমের পরের জনমেও গুরুর সঙ্গে শিষ্যের সাক্ষাৎ হবে। আবার এমনও দেখা যায় যে গুরুর দেহপাত হয়ে গেলে তাঁর সমান উপযুক্ত অন্য কোন মহাত্মাকে তিনি প্রেরণা দেন তাঁর শিষ্যদের ভার নেবার জন্য।

Capture

সদ্‌গুরুর কাজ ও চাষীর কাজ একই পর্যায়ের –

ত্রিতাপ জ্বালা না হলে গুরুর কাছে কেউ যায় না। ত্রিতাপ জ্বালা পেয়ে তারপরে গুরুর কাছে যায়। তখন গুরুর কাছে নাম পায়। গুরুদত্ত সেই নাম যতই করে জ্বালাও ততই বাড়তে থাকে; তারপরে এগুলো পুড়ে ছাই হয়ে গেলে গুরু তখন কাজ করেন।
সব গুরুই জগতে চাষী। তাঁরা জমির খবর রাখেন এবং আবহাওয়ার খবর ও রাখেন। দেহ-জমির ব্যপারে গুরুমাত্রই খবর রাখেন। তাঁরা ৪৯ বায়ুর খবরও রাখেন। কখন কোন বায়ুতে ফসল ফলাবার সময় ভালো সে খবরই তাঁদের রাখতে হয়।
*সদ্‌গুরুর আশ্রয় পাওয়া খুব কম লোকের পক্ষেই সম্ভব হয়। সদ্‌গুরু বাড়ি বাড়ি যান এই জন্য যে কোন বাড়িতে একজনকেও যদি তিনি মহাপুরুষ তৈরি করতে পারেন তবে তাঁর দ্বারা আবার অনেকের উপকার হয়। কোন বংশে একজন মহাপুরুষ যদি জন্মগ্রহণ করেন তবে চৌদ্দ পুরুষ উদ্ধার হয়ে যায়। পিতৃপুরুষগণ, বিদেহীগণ যেখানেই থাকুন না কেন সেই ফল তাঁরাও পান। ক পরিবারে জন্মগ্রহণ করে যদি পরের বার অন্য জায়গায় গিয়েও জন্মগ্রহণ করেন তথাপি সম্বন্ধ থেকে যায়।[read more=”Read More…” less=”Read less”]প্রথমেই গুরুকৃপার তাৎপর্য ধরতে পারা যায় না। নিজের চেষ্টা কতটা হচ্ছে বা হচ্ছে না তা ধরা পড়ে সৎসঙ্গে এলে। নিজে চেষ্টা করে যখন হয় না তারপর হঠাৎ যখন গুরুর কৃপায় তা হয়ে যায় তখনই বুঝতে পারা যায় গুরুকৃপার তাৎপর্য। চেষ্টা না থাকলে গুরুর কৃপা বুঝতে পারা যায় না। জীবনে কত ভাল জিনিস মানুষ পায় কিন্তু কৃতজ্ঞতার অভাবে তা স্বীকার করতে চায় না। কিন্তু যখন কোন একটা বিশেষ জিনিস প্রাপ্তির আশায় সে বহু চেষ্টা করা সত্ত্বেও তা না পেয়ে নিরাশ হয় এবং পরে তা হঠাৎ অযাচিত ভাবে পেয়ে যায় কোন প্রকারে তখনই গুরুকৃপার তাৎপর্য সে বুঝতে পারে এবং তার ভিতরে কৃতজ্ঞতাবোধে জাগে।[/read]

Capture

সদ্‌গুরুগণ সকলের দুঃখের বোঝা বহন করেন –

সদ্‌গুরুর মত দুঃখী কেউ নেই। দুঃখীর বোঝা বয়েই একজন সদ্‌গুরুতে পরিণত হন। তাঁরা দুঃখের বোঝা নেন কারণ তাঁরা স্বয়ং ঈশ্বর। একমাত্র ঈশ্বরই অনেকের দুঃখকষ্টের দায়িত্ব নেন। সদ্‌গুরু সব জায়গাতেই পাওয়া যায়। সদ্‌গুরু লোকের সংস্পর্শে এসেই সদ্‌গুরু হন। নির্জনে জনশূন্য স্থানে সদ্‌গুরু হওয়া যায় না। জ্বালা যন্ত্রণার মধ্যে স্থির থাকা খুব সহজ নয়। সদ্‌গুরুরাই পারেন হাজার রকম শিষ্য-ভক্তের হাজার রকম বায়না মেটাতে ও জ্বালা-যন্ত্রণা সহ্য করতে। সংসারে দু’চারজন লোক নিয়ে ঘর করতে কতরকম অশান্তি, ঝামেলা সহ্য করতে হয়, কতরকম ভিন্ন ভিন্ন ব্যবস্থা করতে হয়![read more=”Read More…” less=”Read less”]সদ্‌গুরু কখনো পক্ষপাতিত্ব করেন না। তিনি হলেন সত্তা। সত্তা সর্বদাই সমান। প্রকাশের মধ্যে শুধু তারতম্য থাকে। সেজন্য বহিঃপ্রকৃতিতে একটা অংশ আছে বৈচিত্র‍্যের মধ্যে, আরেকটি অংশ আছে অন্তরে স্বভাবের মধ্যে। যত বড় বুদ্ধিমানই হোক তাদের মধ্যে স্বভাবের পরিচয় সব সময় পাওয়া যায় না। স্বভাব ও প্রকৃতির মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে। এই দুটি মিলে যায় গুরু যখন আশ্রিত সন্তানকে গুরু বানিয়ে দেন, মহান লঘুকে মহান বানিয়ে দেন।[/read]

Capture

সদ্‌গুরুর কর্মপদ্ধতি –

সদ্‌গুরু লাভ হলে তার চাওয়া-পাওয়ার আর কিছু বাকি থাকে না। সদ্‌গুরু লাভ করা অপেক্ষা বড় লাভ আর কিছু নেই। সর্‌গুরুর কাছে গেলে লাখ জনম কমে এক জনমে এসে দাঁড়ায়। সৎ-এর আছে শুধু এক।

Capture

গুরুতত্ত্বই হল চরম তত্ত্ব ও পরম তত্ত্ব –

*গুরুর হাতেই জীবন্মুক্তির চাবিকাঠি। উত্তম ও যোগ্য অধিকারীই তা পেয়ে থাকে। সুতরাং সমগ্র অধ্যাত্মসাধনার মূল উদ্দেশ্য হল নিজের যোগ্যতার মান তৈরি করা; অর্থাৎ জন্ম জন্মান্তরের সঞ্চিত ও অর্জিত সর্বপ্রকার শুভাশুভ সংস্কার নাশের নিমিত্ত ও গুরুনির্দিষ্ট পথে নিষ্ঠাসহকারে সাধন দ্বারা অন্তরে সাত্ত্বিক ভাবের বিকাশ লাভ করা। সাত্ত্বিক ভাবের প্রভাবে তম-রজোগুণের মল শোধিত হয় বলে স্বভাবের যোগ্যতা তৈরি হয়। তখন স্ববোধ আত্মার প্রতিফলন শুদ্ধভাবে অবাধিত ভাবে হতে থাকে।

Capture

সদ্‌গুরুই ধীরে ধীরে শিষ্যকে স্বরূপে প্রতিষ্ঠিত করে দেন –

*গুরুর হাতেই জীবন্মুক্তির চাবিকাঠি। উত্তম ও যোগ্য অধিকারীই তা পেয়ে থাকে। সুতরাং সমগ্র অধ্যাত্মসাধনার মূল উদ্দেশ্য হল নিজের যোগ্যতার মান তৈরি করা; অর্থাৎ জন্ম জন্মান্তরের সঞ্চিত ও অর্জিত সর্বপ্রকার শুভাশুভ সংস্কার নাশের নিমিত্ত ও গুরুনির্দিষ্ট পথে নিষ্ঠাসহকারে সাধন দ্বারা অন্তরে সাত্ত্বিক ভাবের বিকাশ লাভ করা। সাত্ত্বিক ভাবের প্রভাবে তম-রজোগুণের মল শোধিত হয় বলে স্বভাবের যোগ্যতা তৈরি হয়। তখন স্ববোধ আত্মার প্রতিফলন শুদ্ধভাবে অবাধিত ভাবে হতে থাকে।

Capture

সদ্‌গুরুগণ নিত্যকালই বিদ্যমান থাকেন –

ভগবান বা সদ্‌গুরু হারিয়ে যান না। তাঁরা শুধু পোশাক পালটিয়ে বার বার আসেন। রামরূপ ভগবানের এক পোশাক, কৃষ্ণরূপ ভগবানের এক পোশাক, চৈতন্যরূপ ভগবানের এক পোশাক। সদ্‌গুরু বা ভগবান দেহরূপ ধারণ করে যখন আসেন তখন তাঁর লক্ষণ হল যে তিনি সকলকে একের বিজ্ঞানটি ধরিয়ে দিয়ে যান। বাইরে যত বৈচিত্র্যই থাকুক না কেন সব বৈচিত্র্যময় প্রকাশের অন্তরালে এক অখণ্ড ভূমা সচ্চিদানন্দস্বরূপ সত্তাই বিদ্যমান।[read more=”Read More…” less=”Read less”]সুখে দুঃখে নরবেশে মানুষের মধ্যে তিনি নেমে আসেন। ঊর্ধ্বে থাকলে সবার সঙ্গে মিশে থাকা যায় না। তাই রাজার ঘরে জন্মগ্রহণ করেও চলে এলেন গোয়ালার ঘরে – সেখানে রাখাল বালকের সঙ্গে হাটে-ঘাটে-মাঠে গান গেয়ে গরু চরাতেন।
সদ্‌গুরুগণ পাহাড়-পর্বতে তপস্যা করেন, আবার নেমে এসে গরিব-দুঃখীর বাড়িতেও যান এবং মাঝে মাঝে বড়লোকের বাড়িতেও যান। গরিব-দুঃখীর জন্য যদি প্রাণ না কাঁদত তবে দরিদ্রনারায়ণ সেবার নির্দেশ দিতেন না। রাজার ঘরেই যদি শুধু যেতেন গরিবদের জন্য না করে তাহলে তাঁকে আর সদ্‌গুরু বলা যেতে পারে না…।[/read]

Capture

গুরুর অপরিহার্যতা –

গুরুকৃপা পেলে অনুভূতি হতে আর আটকায় না। গুরুবরণ করা একান্ত প্রয়োজন। গুরু ছাড়া শাস্ত্র পড়ে বিশেষ লাভ হয় না। গুরুমুখে শাস্ত্র শ্রবণ হলে তবে হবে। কারণ শাস্ত্রের সার বস্তু গুরুমুখে শ্রবণ করতে হয়। ভগবান ওটা তাঁদের মুখে রেখেছেন বলে গুরুকৃপা ও সারবস্তু দিয়ে পেতে হয়। গুরু যাকে আশীর্বাদ করেন, শাস্ত্র অধ্যয়ন না করলেও তার চলে। গুরু যাকে আশীর্বাদ করেন সমস্ত দেবদেবী তাকে আশীর্বাদ করেন। তাহলে তার মধ্যে সত্ত্বগুণ প্রকাশ হয়। সত্ত্বগুণ প্রকাশ হলে ঈশ্বরীয় অভিব্যক্তি প্রকাশ হতে দেরি হয় না।

Capture

গুরুমুখে শ্রবণ করেলেই ধর্মের সব তত্ত্ব সহজবোধ্য হয় –

যাঁরা সদ্‌গুরু মহাপুরুষ হয়েছেন তাঁরা তাঁদের গুরুদেবের কথা শ্রদ্ধা সহকারে মেনে গেছেন। তাঁরা বলেন – ‘আমি যন্ত্রমাত্র, গুরুই সব বলেন এবং গুরুই সব করেন’। সদ্‌গুরু কীভাবে যে আকর্ষণ করেন ৎ ধারণাও করা যায় না। ‘সৎ’ অর্থ এক এবং একই মহান। নিত্য এক যিনি তাঁর চাইতে মহান কেউ নেই। এই একের মধ্যে বাস করেন তাঁর সন্তান বা প্রকৃতি। এই বোধে বাস করলে লক্ষ লক্ষ বৎসরের ব্যাধি ও বিকার সবই বিদূরিত হয়ে যায়।

Capture

সদ্‌গুরুগণ নিত্যকালই বিদ্যমান থাকেন –

ভগবান বা সদ্‌গুরু হারিয়ে যান না। তাঁরা শুধু পোশাক পালটিয়ে বার বার আসেন। রামরূপ ভগবানের এক পোশাক, কৃষ্ণরূপ ভগবানের এক পোশাক, চৈতন্যরূপ ভগবানের এক পোশাক। সদ্‌গুরু বা ভগবান দেহরূপ ধারণ করে যখন আসেন তখন তাঁর লক্ষণ হল যে তিনি সকলকে একের বিজ্ঞানটি ধরিয়ে দিয়ে যান। বাইরে যত বৈচিত্র্যই থাকুক না কেন সব বৈচিত্র্যময় প্রকাশের অন্তরালে এক অখণ্ড ভূমা সচ্চিদানন্দস্বরূপ সত্তাই বিদ্যমান।[read more=”Read More…” less=”Read less”]সুখে দুঃখে নরবেশে মানুষের মধ্যে তিনি নেমে আসেন। ঊর্ধ্বে থাকলে সবার সঙ্গে মিশে থাকা যায় না। তাই রাজার ঘরে জন্মগ্রহণ করেও চলে এলেন গোয়ালার ঘরে – সেখানে রাখাল বালকের সঙ্গে হাটে-ঘাটে-মাঠে গান গেয়ে গরু চরাতেন।
সদ্‌গুরুগণ পাহাড়-পর্বতে তপস্যা করেন, আবার নেমে এসে গরিব-দুঃখীর বাড়িতেও যান এবং মাঝে মাঝে বড়লোকের বাড়িতেও যান। গরিব-দুঃখীর জন্য যদি প্রাণ না কাঁদত তবে দরিদ্রনারায়ণ সেবার নির্দেশ দিতেন না। রাজার ঘরেই যদি শুধু যেতেন গরিবদের জন্য না করে তাহলে তাঁকে আর সদ্‌গুরু বলা যেতে পারে না…।[/read]

Capture

গুরু পক্ষপাতিত্ব করেন না, শিষ্যের যোগ্যতা বুঝেই দেন –

*গুরু যে বীজমন্ত্র দেন তাতে ভক্তিবারি সিঞ্চন করতে হয়, তা না হলে পোকামাকড়ে বীজ খেয়ে ফেলে। এক যথার্থ শিষ্য যদি মেলে সে-ই আবার যথার্থ গুরুতে পরিণত হয়। সে তখন সাজা-গুরু নয়, যথার্থ গুরু। ‘গুরু’, ‘গুরু’ বলে ডাকলে মহান বা এককেই ডাকা হয়। যাঁর চাইতে বড় আর কেউ নেই তাঁকেই ‘গুরু’ বলা হয়। গুরু হচ্ছে অব্যয় বীজ। মৃত্যুকেও সে গ্রাস করে। সে মৃত্যুরও মৃত্যু ঘটিয়ে দেয়। যে মৃত্যুকে গ্রাস করে সে হল গুরুর একটা অংশমাত্র। গুরুর আশ্রয়ে গেলে মৃত্যু আর তাকে গ্রাস করতে পারে না।[read more=”Read More…” less=”Read less”]এক মহাপুরুষের কাছে দু’জন গরিব লোক দীক্ষা নিতে এসেছে একদিন। মহাপুরুষ তাদের বললেন – তোমরা দীক্ষা নিতে এসেছ, এতো খুব ভাল কথা; কিন্তু আজ এক্ষুনি বিশেষ কাজে স্থানান্তরে যাচ্ছি কিছু দিনের জন্য সেখান থেকে ঘুরে এসে পরে আমি তোমাদের দীক্ষা দেব। তোমরা বরং এক কাজ কর – আমি তোমাদের দু’জনের কাছে দুটো গমের দানা রেখে যাচ্ছি, খুব যত্ন করে রেখো। ফিরে এলে গমের দানা দুটি আমাকে ফিরিয়ে দিতে হবে, তখনই তোমাদের দীক্ষা হবে। সাবধানে রাখবে পোকামাকড় যেন এই গম নষ্ট করে না ফেলে।
একজন লোক ভাবল বীজটা যত্ন করে রাখতে হবে কারণ এটি আবার গুরুদেবকে ফিরিয়ে দিতে হবে নয়তো গুরুদেব দীক্ষা দেবেন না। সে একখণ্ড কাপড়ে জড়িয়ে যত্ন করে একটা কৌটার মধ্যে ভরে সাবধানে রেখে দিল।
দ্বিতীয় লোকটি ভাবল – মহা মুশকিল, গুরুতো দিয়ে গেলেন বীজটি, কিন্তু কীভাবে রাখব? নষ্ট হয়ে যায় যদি তবে তো আমার দীক্ষা নেওয়াই হবে না। কৌটাতে রাখলে তো পোকায় খেয়ে ফেলবে। এই ভেবে সে একটি মাটির পাত্র মাটি দিয়ে ভরে তার মধ্যে গমের দানাটি পুঁতে রাখল এবং রোজই সে নজর রাখতে লাগল পোকায় যেন না খায়ে অথবা পাখিতে যেন না খায়। প্রতিদিন সে মাটির পাত্রে একটু একটু করে জলও দিতে থাকে।
কিছুদিন পরে সে দেখতে পায় যে বীজ থেকে গাছ বেরিয়েছে। তারপর আরো কয়েকদিন পরে দেখতে পেল যে সেই গাছে অল্প কয়েকটি গমও হয়েছে। যথাসময় লোকটি সেই গমগুলি অন্য একটি বড় মাটির পাত্রে মাটি ভরে তার মধ্যে পুঁতে দিয়ে যত্ন করতে থাকে। সেগুলি থেকে কিছুদিন পরে আরো গাছ হল এবং তাতেও বেশ কিছু গম হল। এদিকে গুরুদেব তখনো ফিরে আসেন নি। নূতন গমগুলি নষ্ট হয়ে যাবে মনে করে আবার একটি খুব বড় মাটির গামলায় মাটি ভরে তার মধ্যে সব গমগুলি পুঁতে রাখল এবং যথারীতি যত্ন করতে শুরু করল। পড়ে সেখান থেকেও অনেক গাছ হল এবং আরো বেশিগম হল। এবার গমের পরিমাণ এত বেড়েছে যে মাটির গামলায় না পুঁতে সে তা ঘরের পাশে অখণ্ড জমিতে সেগুলি পুঁতে রাখল। সেখান থেকেও অনেক গম হল। এরকম বার বার হয় এবং সেগুলি আবার জমিতে পুঁতে রাখে। গমের পরিমাণ ক্রমশ এত বেশি হতে লাগল যে সে কিছু কিছু গম বিক্রি করে দিতে লাগল। এইভাবে তার নিজের আহারের সমস্যাও মিটে গেল এবং এবং বাদবাকি গমের চাষ করে সে প্রচুর গম উৎপাদন করতে লাগল। অল্প জমিতে আর হয় না, আরো জমির প্রয়োজন। সে জমি কিনে বড় রকমভাবে গমের চাষ শুরু করে দিল।
এদিকে অনেক দিন হয়ে গেল, গুরু আর ফিরে আসে না। তখন লোকটি গম বিক্রি করে করে বাড়ি ঘর বানিয়ে ফেলল। এইভাবে তার নিজের অবস্থার সম্পূর্ণ পরিবর্তন হল।
প্রায় বার বছর পর গুরুদেব ফিরে এলেন। লোক দু’জনকে তিনি ডাকলেন। গুরুদেব গমের কথা জিজ্ঞাসা করাতেই প্রথম লোকটি কৌটা থেকে বার করে দেখল যে বীজটা নষ্ট হয়ে গেছে।
দ্বিতীয় লোকটি বলল – “আপনার এই বীজটা যত্ন করে রাখতে গিয়ে সারাদিনই আমার এর পিছনে পরিশ্রম করতে হয়েছে। আর কোন দিকেই আমার দৃষ্টি দেবার অবসর ছিল না”।
সেই গম হতে চাষ করে করে লোকটি যা সম্পদ করেছে সব গুরুদেবকে দেখাল। ধামা ভরে ভরে গম রেখেছে তাও দেখাল।
গুরু সেসব দেখে তাকে বললেন – “তুই যে বীজমন্ত্র রক্ষা করতে পারবি সেটাই বুঝতে পারলাম। আয়, তোকে আমি এখনই দীক্ষা দেব”। এইভাবে এখানেই দুজনের পরীক্ষা হয়ে গেল।
তিনি প্রথম লোকটিকে বললেন – “দেখ, সামান্য জিনিস, এটাকেও তুই নষ্ট করে দিলি, আর ওই লোকটি একটামাত্র দানা থেকে অবস্থাটা কী রকম পালটে ফেলেছে !”
সত্যি সত্যি গুরুদত্ত বীজ ব্যবহার করার জন্য কয়জন তৈরি হয়?[/read]

Capture

আত্মোপলব্ধি বা ঈশ্বরানুভূতির জন্য এযুগে শ্রবণই হল অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপায় –

গুরুকে ব্যক্তিবোধে নিতে নেই। বৈষ্ণবদের দোঁহা আছে –
“যদ্যপি আমার গুরু শুঁড়ি বাড়ি যায়
তথাপি আমার গুরু নিত্যানন্দ রায়”।
এখানে ব্যক্তি গুরুর কথা বলা হয়েছে। কিন্তু ‘এর’ তো ব্যক্তি হিসাবে গুরু করা হয়নি – গুরুবোধে নেওয়া হয়েছে। গুরু বলে মনুষ্যদৃষ্টি রাখলে উপকার পাওয়া যায় না। যে বোধে গুরুকে নেবে, সেইরকম কাজ হবে।[read more=”Read More…” less=”Read less”]দৃষ্টান্তস্বরূপ একটি ছোট গল্প বলছি, শন – এক মূর্খ লোক অভাব অনটনের জ্বালায় গুরুগিরি করা শুরু করেছে। একদিন তার এক শিষ্য মূর্খ গুরুকে নিয়ে এক জায়গায় যেতে যেতে সামনে এক নদী দেখতে পেল। শিষ্য তো ‘জয় গুরু, জয় গুরু’ বলে নদী পার হয়ে গেল স্বচ্ছন্দে।
মূর্খ গুরু শিষ্যের নদী পার হওয়া দেখে অবাক হয়ে গেল। পরে মূর্খ গুরুও ‘জয় আমি, জয় আমি’ বলে নদী পার হতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত ডুবে গেল। তারপর শিষ্যই কোন রকমে তার প্রাণ বাঁচায় …।
সব কিছুই যে বোধে ব্যবহার করা হয় সেরকমই উপকার পাওয়া যায়। পাথরকে নারায়ণ বোধে ব্যবহার করা হয় বলেই উপকার পাওয়া যায়। হিন্দুর ধর্মের নির্দেশ – মাটির মূর্তি তৈরি করে তার মধ্যে ঈশ্বরকে আরোপিত করে পূজা করলে সেখান হতেই ঈশ্বরপূজার ফল লাভ হয়। ভারতীয় ঋষিদের শ্রেষ্ঠ অবদান – matter হল মা স্বয়ং।[/read]

Capture

দুঃখ, ব্যথা-বেদনার মাধ্যমেই চৈতন্যের জাগরণ হয় –

আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য দুঃখ-কষ্ট, বেদনা-অভাব, রোগ-শোক সব কিছুই প্রয়োজন। দেহের পীড়ার ও দরকার আছে। নয়তো দেহের ভিন্ন ভিন্ন অংশে চৈতন্যের রূপান্তর হয় না। অভাব না হলে জীবন মার্জিত হয় না। যে কোন দিন দুঃখ পায়নি, তার তো জীবন তৈরি হওয়ার সুযোগই হয়নি।

Capture

সদ্‌গুরুর যথার্থ স্বরূপ –

অহংকার-অভিমান হল Consciousness-এরই একটা part যে বাইরের থেকে দেখতে চায়। ভিতর থেকে যে part দেখছে তা হল গুরুশক্তি বা মাতৃকাশক্তি। এই গুরু বা মাতৃকাশক্তির কাজ দেখতে হলে ভিতরের দিকে দেখতে হবে। গুরুশক্তি বা মাতৃকাশক্তির হাতেই সব শক্তি। তাঁর ওপরেই যেন নির্ভরতা আসে। এই গুরুশক্তির ওপর পরিপূর্ণভাবে নির্ভর করতে হয়। তাঁর হাতেই সব দায়িত্ব।[read more=”Read More…” less=”Read less”]এই গুরুর অসম্ভব শক্তি। সে শুধু ব্যক্তি নয়। এই গুরু হলেন এমন একজন যাঁর স্বরূপ হল Impersonal Personal তথা Infinite Personality of Absolute Oneness – যাঁর পোশাকের কোন অভাব নেই। অনন্ত জীবন হল তাঁর পোশাক। যে কোন একটা পোশাক পরেই তিনি আসতে পারেন। Mind-কে free রাখতে হবে। গুরুকে গুরুবোধেই অর্থাৎ অখণ্ড একবোধে গ্রহণ করতে হবে। পৃথক পৃথক গুরু নয়। এক গুরুরই পৃথক পৃথক দেহরূপ পোশাক। গুরু হলেন নিত্যকালের গুরু, জগদ্‌গুরু। বোধের এই গুরু অমর –
‘সদ্‌গুরু মাত্রই নিত্য বর্তমান
বুঝতে পারে শুধু ভক্ত মহাজন।’[/read]

Capture

সদ্‌গুরুর স্বরূপলক্ষণ –

সদ্‌গুরুদের মাধ্যমে পরিপূর্ণভাবে ঈশ্বর নেমে আসেন। এঁরা গতানুগতিক সাধু-সন্ন্যাসী নন। তাঁদের সঙ্গে কাউকে তুলনা করা যায় না। তাঁদের মধ্যে হয় শুধু একের খেলা। বহুর মধ্যে এক যে common সেইটিই তাঁদের লক্ষ্য। যখন এক একটি একের সুরে বাঁধা হয়ে আসে তার background-এ থাকে নানাত্ব-বহুত্বের সর্বরকম প্রভাব। সেইসকল প্রভাব কীভাবে অতিক্রম করে এসেছে তা-ই হল জীবনের সর্বাপেক্ষা আশ্চর্যজনক ঘটনা। তাঁরা চরমতম অনুভূতির লাভের পরে নিজেদের হৃদয়ের অভিজ্ঞতার কথাই বলেন, মুখস্থ করা কথা বলেন না।

Capture

সদ্‌গুরু ও মহাপুরুষের বাক্যই হল বেদ এবং তাদের আচরণ হল ধর্মবিজ্ঞান –

‘সদ্‌গুরুর কথাই হল জ্ঞান। এই জ্ঞানই তিনি দেন। ইহাই হল তাঁর কৃপা’। বাক্‌ই সত্য। বাক্‌ ছাড়া আর যা কিছু দেন সব secondary। বাক্যটা secondary নয়। ‘মহাপুরুষদের বাক্যই হল বেদ এবং তাঁদের আচরণ হল বিজ্ঞান’।

Capture

গুরুকৃপার মহিমা –

‘ঈশ্বরের জীবন্ত বিগ্রহ হল সদ্‌গুরুগণ’। ঈশ্বরকে তাঁরা প্রত্যক্ষ ধরিয়ে দেন এবং তাঁদের মধ্যেই ঈশ্বর লীলায়িত হন। সদ্‌গুরু বাইরে মানুষ, কিন্তু পরিপূর্ণভাবে ঈশ্বর। তাঁর ছিটেফোঁটা কৃপা পেলেও এক একজন মানুষ মহারথী হয়ে যায়। ‘ঈশ্বরকে সদ্‌গুরুর মধ্যে ভাবনা এবং সদ্‌গুরুকে ঈশ্বররূপে ভাবনা করা একই অর্থ।
সদ্‌গুরু বা ঈশ্বরের কৃপা ছাড়া হৃদয়ে প্রেমের প্রকাশ হয় না। যারা ইচ্ছামত বই-পুস্তক পড়ে ঈশ্বরকে পেতে চায় তাদের মধ্যে এই প্রকাশ হয় না।[read more=”Read More…” less=”Read less”]ধৈর্য, স্থৈর্য ও সহিষ্ণুতা আসে সৎসঙ্গের ফলে। ইহাই গুরুকৃপা। এই গুরুকৃপা ধার করেও পাওয়া যায় না, বাজারেও পাওয়া যায় না। গুরুর নির্দেশ যথাযথ মেনে চললে এর উপলব্ধি হয়। গুরুগত বিদ্যা হল পরাবিদ্যা। তাই তার নাম গুপ্তবিদ্যা। এসব বারোয়ারী বিদ্যার মত নয়, তাই এই বিদ্যা এঁটো হয় না।
গুরু প্রসঙ্গে একটি গল্প শোন – খুব অসৎ চরিত্রের এক গৃহস্থ ছিল। সে খুব কামুক, মদ্যপায়ী, স্ত্রৈণ ও বিলাসী ছিল। তার মধ্যে সর্বপ্রকার অসদ্‌গুণই ছিল।
এক বন্ধুর পাল্লায় পড়ে সে একদিন এক সদ্‌গুরুর কাছে উপস্থিত হল; কিন্তু তার সেখানে ভাল লাগেনি। তবুও বন্ধুর সঙ্গে তার সেখানে মাঝে মাঝে আসতে হয়। সদ্‌গুরু তাকে প্রসাদও দেন এবং স্নেহভরে দু’চারটে কথাও বলেন। তিনি কিন্তু লোকটির মনের কথা সব বুঝতেও পারেন।
গুরু – “লজ্জা হল দৈবী গুণ। লজ্জা এলে কুকাজের বৃত্তি আপনিই চলে যায়। লজ্জারূপে মাতাই তার মধ্যে থাকে। লজ্জারূপে সে না থাকলে তো কুকাজও বন্ধ হয় না। এখানে লজ্জারূপে প্রকাশিত মাতা। শাস্ত্রে তাই বলা আছে ‘যা দেবী সর্বভূতেষু লজ্জারূপেন সংস্থিতা’। মাতা লজ্জারূপে যার মধ্যে প্রবেশ করে সে আর কুকাজ করতে পারে না…”।[/read]

Capture

উত্তম অধিকারী ভিন্ন মহাপুরুষের নিত্যসঙ্গ অসম্ভব –

জগতে মনুষ্যদেহ লাভ, মুমুক্ষুতা ও মহাপুরুষদের সংশ্রব এই তিনটিকে সর্বাপেক্ষা দুর্লভ বলা হয়েছে। প্রথম দু’টি যদিও বা লভ্য কিন্তু তৃতীয়টি অত্যন্ত দুর্লভ। মহাপুরুষের কৃপা পাওয়া যায় কিন্তু নিরন্তর তাঁর সঙ্গ পাওয়া সবার পক্ষে সম্ভব হয় না। কেবল মাত্র উত্তম অধিকারীর পক্ষেই তা ঘটে থাকে। বহু জন্মের সুকৃতির ফলেই জীব উত্তম অধিকারীতে পরিণত হয়। সবই নির্ভর করে অন্তরের ব্যকুলতা, তীব্র ইচ্ছা, সততা, নিষ্ঠা, শ্রদ্ধা, ভক্তি ও বিশ্বাসের উপরে।

Capture

কেবলমাত্র উত্তম অধিকারীর পক্ষেই সমাধিসিদ্ধ হওয়া সম্ভব –

সবিকল্প বা সম্প্রজ্ঞাত সমাধির বিজ্ঞান সম্যক্‌রূপে অধিগত হলে সমাধির পূর্ণ সিদ্ধি লাভের জন্য যে সাধকের অন্তরে আত্মানুভূতির তীব্র ইচ্ছা ও ব্যকুলতা জাগে এবং পূর্ণাঙ্গ সমাধিসিদ্ধির জন্য সদ্‌গুরুর সাহায্যে গভীর আত্মধ্যানে মগ্ন হতে চায়, তারাই উত্তম অধিকারী। এইরূপ যোগ্য অধিকারী সাধক সদ্‌গুরুর সাহায্যে সবিকল্প সমাধির সম্যক্‌ অভিজ্ঞতা ও অনুভূতি লাভের পর নির্বিকল্প বা অসম্প্রজ্ঞাত সমাধির সাধন আরম্ভ করেন। সদ্‌গুরুর কৃপা, ঈশ্বরের অনুগ্রহ এবং স্বকীয় চেষ্টার উৎকর্ষে, সাধনার মাধ্যমে যথাযথ ভাবে নির্বিকল্প সমাধির পূর্ণ অধিকার লাভ করেন। এই ভাবে সে অসম্প্রজ্ঞাত সমাধি লাভে সমর্থ হয়। এই সমাধির সিদ্ধি হয় তার দীর্ঘকাল অভ্যাসের পর। এই হল প্রকৃতির শেষ অবস্থা। অর্থাৎ অব্যক্তে প্রতিষ্ঠা। এখান থেকেই শুরু হয় নির্বিকল্প সমাধি তথা আত্মস্বরূপে স্থিতির বিজ্ঞানসিদ্ধি।
এই অবস্থায় সুপ্রতিষ্ঠিত সাধকের ধর্মমেঘ সমাধি হয়। এই সমাধি অতি দুর্লভ। সব সাধকের এই সমাধি হয় না।

Capture

গুরুতুষ্টিসাধন তপস্যারই পরিণাম –

তপস্যা ও সাধন ব্যতিরেকে শুধু গুরুবাক্যের অন্তর্ভুক্ত চরমতম বাণী ও কথাগুলির অনুশীলন ও ব্যবহার কোনও মতেই কার্যকারী ও ফলপ্রদ হতে পারে না। তা অপরের এবং নিজের বিকার সৃষ্টির কারণ হয়। কারণ গুরু তুষ্ট না-হলে গুরুবাক্য শ্রোতার অন্তরে কার্যকারী ও ফলপ্রদ হয় না। অভিমানী চিত্ত বা মন স্বার্থসিদ্ধি ও প্রতিষ্ঠার কাজে রত থাকে। গুরুতুষ্টির জন্য তার চেষ্টা হয় না। গুরুপ্রীতির জন্য যে সাধনা তা অভিমানী চিত্ত মুখে অপরের কাছে বলে কিন্তু তা নিজে সম্যক্‌রূপে মানেও না এবং সাধনও করে না।

Capture

গুরুপ্রীতি সাধনের মধ্যমে আপনবোধের বিকাশ ও তার ফলে তপস্যার গতি সমাধিতে পরিণত হয় –

গুরুভাব গুরুপ্রীতি সাধনের মাধ্যমেই স্ববোধ বা আপনবোধ রূপে ফুটে ওঠে। বিনা তপস্যায় সমাধি হয় না। বিনা সমাধিতে সিদ্ধিলাভও হয় না। যাদের পূর্ণাঙ্গ সমাধিসিদ্ধি হয়নি, তাদের তত্ত্ববিজ্ঞানের অনুশীলন ও ব্যবহার চিন্তা, বাক্য ও কাজের মধ্যে ফুটে ওঠে না। সেই জন্য তাদের অন্তরে বিকার সৃষ্টি হয় ও ক্ষোভ প্রকাশ হয়। তারা পরদোষ দেখে ও পরনিন্দা ও পরচর্চা করে। তা-ই হল অন্তরের মল। তমোগুণ ও রজোগুণের প্রভাবেই তা ঘটে থাকে।

Capture

গুরুবাণী ব্যবহারের ত্রুটি প্রসঙ্গে বিধান ও নিষেধ –

গুরুবাক্যের বৈশিষ্ট্য স্বানুভবসিদ্ধ বলে তা অনুগত ও শরণাগতগণ ব্যক্তিগত ভাবে ব্যবহার করতে পারে না। স্বানুভবসিদ্ধ গুরুবাণীকে অন্য শাস্ত্রবাক্য বা মহাজনবাক্যের সঙ্গে যুক্ত কর ব্যবহার করা নিষিদ্ধ। কারণ ‘স্বানুভবসিদ্ধ গুরুবাণী’ নিত্য, পূর্ণ ও শুদ্ধ সত্যের বাণী। তা অবিমিশ্র, বিকাররহিত। বিকারী মন স্বার্থসিদ্ধির জন্য এর ব্যবহার করলে তা বিকারগ্রস্ত হয়। অন্য সাধু-মহাত্মার কথার সঙ্গে যুক্ত করে ব্যবহার করলেও তা পরম অপরাধরূপে গণ্য হয়। এগুলি হল গুরুবাণী ব্যবহারের ত্রুটি প্রসঙ্গে বিধান ও নিষেধ। এই বিধি-নিষেধ অমান্যকারীদের মধ্যমেই যুগে যুগে সত্যানুভূতির মানের বিকার হয়। বুদ্ধিদোষ ও ব্যবহারদোষে গুরুবাণীর শক্তি আবৃত হয়ে যায়। আচরণ শুদ্ধ না-হওয়া পর্যন্ত তা বলা, কওয়া ও লেখা অপরের পক্ষে কোনও মতেই সঙ্গত নয়। নিজের প্রস্তুতির জন্য যে-অংশ একান্ত দরকার তা ছাড়া অন্য প্রসঙ্গ চর্চা করা মানেই অনধিকার চর্চা। স্বানুভবসিদ্ধ গুরুবাণীর সব অংশ সবার জন্য নয়। তা ব্যবহারের অধিকারও সবার নেই। ব্যবহারদোষে গুরুবাণীর শক্তি আবৃত হয়ে যায় যখন, তখনই হয় ভাবাদর্শের বিকার ও পতন।

Capture

গুরুর আসন ও তাঁর পাশে উপবেশন –

পরিচয় অর্থ হল পরবর্তী গতি কী হবে তা পূর্বে বলে দেওয়া। তাকেই বলে পরিচয়। ভক্তির পথে জীবনে উৎকর্ষ লাভের বিধান যিনি ধরিয়ে দেন তিনিই গুরু। গুরুর বা ইষ্টর আসন হল সমতা। জীবন শান্তি থেকে আরম্ভ হয়ে শান্তিতে শেষ হয়। নিবনের গতিকে শান্ত না-করলে তাঁর আসনের পাশে বসা যায় না।
ভগবান বা গুরু হলেন বিশুদ্ধ জ্ঞানস্বরূপ এবং বুদ্ধির সাক্ষী, নিত্যপূর্ণ অখণ্ড ভূমা অদ্বয় অব্যয় অমৃতময়। ভূমা অখণ্ড বলে আনন্দ ও প্রেমময়। জ্ঞানস্বরূপ স্বতঃসিদ্ধ, স্বতঃস্ফূর্ত স্বয়ংপ্রকাশ। তাঁর কোনও বিকল্প নেই, বিকারও নেই। সেই জন্য তা নির্বিকার নির্বিকল্প নিষ্কল নির্মল নিরঞ্জন। এই জ্ঞানস্বরূপের নামান্তরই হল সচ্চিদানন্দ (সত্য, জ্ঞান, আনন্দ) – অস্তি, ভাটি, প্রিয়ম। সগুণ-নির্গুণ উভয়ই তাঁর স্বভাব। অতএব তাঁর চিন্তা করা, তাঁর হয়ে কাজ করাই হল জ্ঞানের সেবা করা। ভক্তসেবক সেব্যকে গুরু-ইষ্টবোধে সেবা করে নিষ্কাম কর্মের অনুষ্ঠান করে। সেবার ফলে গুরু-ইষ্ট প্রীত হলে সেবক তার ফল পায়। গুরুর বা ইষ্টর সঙ্গে প্রত্যেকের নিত্যসম্বন্ধ থাকে সত্ত্বেও মোহ-আসক্তির দ্বারা তা আবৃত হয়ে যায়। সেবার দ্বারা সেই আবরণ সরে যায়।

Capture

গুরু এক এবং সর্বব্যাপী –

প্রত্যেকেরই আপন আপন গুরুপ্রদত্ত বীজ ও নামের উপরে আস্থা রাখা উচিত। এক পরমাত্মগুরুর কাছ থেকেই সকলে নাম পায়। তবে স্থূলরূপে ভিন্ন ভিন্ন গুরুর প্রয়োজন হয়। গঙ্গার পাড়ে কত ঘাট! সবগুলি ভিন্ন ভিন্ন মনে হলেও সব এক গঙ্গারই ঘাট। সেইরূপ গুরু সর্বব্যাপী। পৃথিবীর সর্বস্থানে সর্ববস্তুই শ্রীগুরুপদ ভাবনা করে সব জিনিস ব্যবহার করলে গুরুবোধের সঙ্গে সহজেই অভেদে মিলন হয়।

Capture

ব্যক্তিরূপে মূর্ত হলেও সদ্‌গুরু হলেন নৈর্ব্যক্তিক –

দ্বৈতবোধের অর্থাৎ ভেদজ্ঞানের সর্ববিধ সাধনা আত্মলীলার প্রস্তুতি অথবা নিত্যপূর্ণ স্ববোধ আত্মার লীলাচাতুরী। রূপ-নাম-ভাব-বোধের মাধ্যমে আত্মা স্বয়ং নিজেকে প্রকাশ করেন। এগুলি তাঁর প্রকাশ ভঙ্গিমার অবলম্বন। আত্মগুরু মূর্ত হয়েও অমূর্ত, ব্যক্ত হয়েও অব্যক্ত এবং ব্যক্তি হয়েও নৈর্ব্যক্তিক। গুরুকে বাইরে সাধারণ ব্যক্তির মতো দেখালেও তিনি সচ্চিদানন্দঘন। গুরু হলেন অখণ্ড, অব্যক্ত এবং সমগ্র সত্যের কেন্দ্রীভূত জ্ঞানস্বরূপ।

Capture

সদ্‌গুরুর কৃপালাভের উপায় –

সদ্‌গুরুর প্রসঙ্গে যা বলা হয়েছে তা মনে রেখে চললে প্রত্যেকেই গুরুকৃপা লাভে সমর্থ হবে। গুরুকৃপা লাভ হলে বোঝা যায় যে কী ভাবে গুরু ব্রহ্মচর্য লাভ করতে সাহায্য করেন। গুরুকৃপা ব্যতীত শুধু আত্মচেষ্টা দ্বারা মন-প্রাণ-ইন্দ্রিয়ের বিকার সহজে শোধন করা যায় না। যেমন একটা ভিজা কাঁথাকে আগুনে শুকাতে অনেক সময় লাগে; কিন্তু রোদের তাপে অল্প সময়ে তা শুকিয়ে যায়। সেইরূপ আত্মচেষ্টার মাধ্যমে আত্মসিদ্ধি লাভ করা বহু সময়সাপেক্ষ ও কষ্টসাধ্য কিন্তু গুরুকৃপায় তা স্বল্পসময়ে সহজসাধ্য ও পূর্ণ ফলপ্রদ হয়।
‘রোদ’ হল এখানে গুরুকৃপা। তাঁর কৃপা পাওয়ার উপায় হল তাঁর আদেশ বা নির্দেশ যথাযথ পালন করা ও অনুসরণ করা। একসঙ্গে পুরোপুরি ভাবে তা কেউ না –পারলেও স্বল্পমাত্র সাধনের দ্বারাও মহৎ উপকার পাওয়া যায়। দেহ-ইন্দ্রিয়-প্রাণ-মন সহযোগে ইষ্টকে ডাকলে যথার্থ ফল পাওয়া যায়। গুরু বা ইষ্টের উদ্দেশ্য হল এক-এতে অর্থাৎ অখণ্ড সমত্বে প্রতিষ্ঠিত করে দেওয়া।

Capture

সর্বোত্তম অনুভূতি গুরুকৃপা সাপেক্ষ –

সর্বোত্তম অনুভূতি লাভের জন্য সাধকের স্বকীয় চেষ্টার সঙ্গে সদ্‌গুরুর কৃপাশিস্‌ সর্বতোভাবে প্রয়োজন। সাধারণ গুরুদের কাছে সাধারণ উপকরণ ছাড়া বেশি কিছু পাওয়া যায় না। অনেকের ধারণা যে ঈশ্বর যখন সর্বশক্তিমান, তখন তিনিই সব করে দেবেন এবং কারও কিছু করতে হবে না। পরমসিদ্ধি লাভ করতে হলে বিদ্যা, তপস্যা, ইন্দ্রিয়সংযম, ত্যাগ-বৈরাগ্য এবং গুরু-ইষ্টের উপরে নির্ভরতা একান্ত প্রয়োজন। এই পঞ্চবিধ অনুশীলন অন্তরে গুরুশক্তির কৃপাতে জাগ্রত হয়ে পঞ্চবিধ অনুশীলনের মাধ্যমে সাধকের অন্তরে অভিব্যক্ত হয়। মাতা কুণ্ডলিনী শক্তির অভিব্যক্তির লক্ষণ যোগী, জ্ঞানী ও ভক্তের অন্তরে পৃথক পৃথক ভাবে প্রকাশ পায়।

Capture

সাধনসিদ্ধির রহস্য –

গুরুপ্রদত্ত নামসাধনের মাধ্যমে অজপা-জপ আপনিই সাধিত হয়। শ্বাসে শ্বাসে নাম করলে সহজে অজপা-সিদ্ধি লাভ হয়।
সদ্‌গুরুর সাহায্য ব্যতীত শুধু পুঁথি-পুস্তকের জ্ঞান দ্বারা মুক্ত হওয়া সম্ভব নয়। শাস্ত্রের প্রতিপাদ্য বিষয় বিনা সাধনায় দুর্বোধ্য কিন্তু একনিষ্ঠ ভক্তিসহকারে ঐকান্তিক সাধনার মাধ্যমে ঈশ্বরের অনুগ্রহে এবং গুরুকৃপায় তা অনুভবগম্য হয়।

Capture

গুরু চতুর্বিধ, যথা – মহাগুরু, পরমগুরু, পরাপরমগুরু এবং পরাৎপরমগুরু বা পরমেষ্ঠিগুরু। নিত্য, অখণ্ড, এক গুরুর চতুর্বিধ প্রকাশ। –

‘মহাগুরু’-রূপে গুরু হলেন মাতাপিতা এবং জাগতিক শিক্ষাগুরু। তাঁরা বস্তুজগতের পরিচয় এবং সংজ্ঞা ধরিয়ে দেন।
‘পরমগুরু’-রূপে গুরু ঈশ্বরের নাম দিয়ে ঈশ্বরীয় প্রসঙ্গে আধ্যাত্মিক সাধনপদ্ধতি ধরিয়ে দেন।
‘পরাপরমগুরু’-রূপে তিনি জীবনকে মুক্ত করে দেন বা সাধনায় সিদ্ধি এনে দেন।
‘পরাৎপরমগুরু’ হলেন সদ্‌গুরু স্বয়ং। তাঁর মহিমার তুলনা নেই।

Capture

*গুরুকে বাদ দিয়ে ইষ্টের দর্শন হয় না। গুরুর দর্শন হলে গুরুর মধ্যে ইষ্টের দর্শন হয়। তাঁর মধ্যে নিজের স্থান কোথায় তা উপলব্ধি হয় সবার শেষে। অনুভূতির প্রথমে গুরুদর্শন হয়, তাঁর মধ্যে হয় ইষ্টমূর্তি দর্শন। গুরুর মধ্যে ইষ্টমূর্তি ফুটে ওঠে। –

‘দেব, দ্বিজে ও গুরুতে অভেদ যার দৃষ্টি
তারই হয় মুক্তি ও শান্তি’।

Capture

গুরুশক্তির মাধ্যমে গ্রন্থিভেদ সিদ্ধি হয় –

থূল স্তর থেকে সূক্ষ্ম স্তরে যখন বোধের বিকাশ হতে থাকে সে সময় নানাবিধ বিকার যা রোগ, পীড়া প্রভৃতি রূপে পরিচিত, তা অঙ্গাঙ্গি ভাবে তার সঙ্গে যুক্ত থাকে। ক্রমপর্যায় ত্রিগুণের তিন গ্রন্থিভেদের সময় বোধের ত্রিবিধ বিকার দেহে নানা রকম ব্যাধি, পীড়া ও কষ্ট রূপে দেখা দেয়।
নাভিগ্রন্থি থেকে বোধ যখন হৃদয়গ্রন্থিতে ওঠে তখন তমগুনের অন্তর্গত বোধের বিকার দেহে রোগ, ব্যাধি ও বেদন রূপে ফুটে ওঠে। হৃদয়গ্রন্থি ভেদের সময় রজোগুণের অন্তর্গত বোধের বিকার মানুসিক দুঃখ-কষ্ট, ভাবনাচিন্তা ও অশান্তি রূপে দেখা দেয়। রুদ্রগ্রন্থি ভেদের সময় নানা রকম রূপের দর্শন, বিভূতি প্রভৃতি আসে। এগুলিকে সত্ত্বগুণের বিকার বলে। এই তিন গ্রন্থিকে মতান্তরে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।[read more=”Read More…” less=”Read less”]কেউ কেউ ব্রহ্মগ্রন্থিকে রাজসিক বন্ধন, বিষ্ণুগ্রন্থিকে সাত্ত্বিক এবং রুদ্রগ্রন্থিকে তামসিক বন্ধন বলেন। আবার কেউ কেউ ব্রহ্মগ্রন্থিকে সাত্ত্বিক বন্ধন, বিষ্ণুগ্রন্থিকে রাজসিক বন্ধন এবং রুদ্রগ্রন্থিকে তামসিক বন্ধন বলেন। আবার কোনও কোনও মতে ব্রহ্মগ্রন্থিকে তামসিক বন্ধন, বিষ্ণুগ্রন্থিকে সাত্ত্বিক বন্ধন এবং রুদ্রগ্রন্থিকে রাজসিক বন্ধন বলা হয়। মেঘের খেলার মতো সব স্তরের বিকারই ক্ষণস্থায়ী। সুতরাং কোনটিকেও গুরুত্ব দিতে নেই।
সর্বস্তরের বিকার অতিক্রম করার জন্য গুরুশক্তি সাহায্য করে। সদ্‌গুরু অন্তরালে থেকে অন্তরের অন্তরায়গুলি দূর করে দেন। এ-ই তাঁর বিশেষত্ব। বাইরে থেকে তাঁর মহিমা বোঝার উপায় নেই। তিনি জ্ঞানস্বরূপ। জ্ঞান বা বিজ্ঞান তাঁর প্রকাশমাত্র। তাঁর অজ্ঞাত কিছু নেই। সদসৎ, ভাল-মন্দ প্রভৃতি দ্বৈত প্রতীতি তাঁর নেই কারণ সদ্‌গুরু নিত্য সমবোধে প্রতিষ্ঠিত।[/read]

Capture

সকল গুরুই অখণ্ড এক গুরুর অন্তর্ভুক্ত –

যিনি সৎ-অসৎ, পুরুষ-প্রকৃতি প্রভৃতি দ্বিবিধ তত্ত্ব সম্বন্ধে সম্যক্‌ ভাবে অবহিত তিনিই সদ্‌গুরু। দ্বৈততত্ত্বের কোনও একটিমাত্র পৃথক সাধনা হয় না এবং তার পূর্ণতার পরিচয় লাভ করা যায় না। গুরুপ্রদত্ত পদ্ধতি অনুযায়ী আপন আপন গুরুর নামকীর্তন করলে পরম গুরুরই ভজন ও নামকীর্তন করা হয় এবং আপন গুরুর মধ্যে পরম ইষ্টকেই পাওয়া যায়।[read more=”Read More…” less=”Read less”]দীক্ষিতদের জন্য নির্দেশ হল – আপন সাধনপদ্ধতি ঠিক রেখে অর্থাৎ আপন সাধনপদ্ধতির অনুকূলে যা পাওয়া যায় তা গ্রহণ করে প্রতিকূলের থেকে সরে থাকতে হয়। আত্মগুরুর পরিচয় সব সময় এক। সকল গুরুই অখণ্ড এক পরমাত্মগুরুর অন্তর্ভুক্ত ও তাঁর প্রতিনিধি। অর্থাৎ অখণ্ড এক পরমাত্মগুরুই নিত্যবিদ্যমান। এক গুরুতত্ত্বের সঙ্গে যার পরিচয় ঘটেছে তার মাধ্যমে প্রত্যেক গুরু আপন আপন সন্তানের জন্য তেজ, বীর্য, শক্তি ব্যবহার করেন। সদ্‌গুরুর কর্মপদ্ধতি সাধারণের পক্ষে দুর্বোধ্য। সাধারণ মানুষ না-বুঝে অনেক সময় এ কথা অনুমান করে। কিন্তু যারা অনুভব করে তারা প্রকৃত পরিচয় পায়। বোধের অনুভূতি বোধের মধ্যেই ফুটে ওঠে। অনুমান হয় মনে; যদিও মন এক বোধস্বরূপের অন্তর্গত প্রকাশমাধ্যম মাত্র। কিন্তু তা শুদ্ধ হলে স্ববোধের সহায়ক, আবার অশুদ্ধ হলে অন্তরায় হয়।[/read]

Capture

গুরুতত্ত্ব ও গুরুশক্তির গুরুত্ব ও তাৎপর্য অভিনব –

যে শক্তি সর্বদা অখণ্ড বোধের সমতা ও তার গুরুত্ব রক্ষা করে তাকেই গুরুশক্তি বলে। গুরুশক্তি দেবশক্তি অপেক্ষাও বড়। গুরুতত্ত্ব অর্থাৎ আত্মতত্ত্ব বা ব্রহ্মতত্ত্ব সর্বশ্রেষ্ঠ তত্ত্ব। গুরুতত্ত্ব অতীব জটিল। ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বরও নিরন্তর গুরুভজন করেই আপন আপন দায়িত্ব পালনে সক্ষম হন। দেবদেবীরা পরব্রহ্ম বা পরমাত্মা গুরুকে উপাসনা না-করে পারে না।
গুরুতত্ত্ব হল পরমাত্মতত্ত্ব যা সর্বতত্ত্বের সার। গুরুতীর্থ সর্বশ্রেষ্ঠ তীর্থ। গুরুকৃপা হল সর্বোত্তম কৃপা। গুরু হলেন মোক্ষস্বরূপ। তিনি সর্বাতীত হয়েও সর্বাত্মক। গুরু রুষ্ট হলে চারণ, গন্ধর্ব, মাতৃকাশক্তি, সিদ্ধপুরুষ, মুনি, ঋষি প্রভৃতি কারওর ক্ষমতা নেই তাঁকে তুষ্ট করার।

Capture

গুরুসেবা ও পূজার বিধান –

আপন আপন গুরুকে শিব-বিষ্ণুবোধে যে ধ্যান করে, সে-ই প্রকৃত গুরুভক্ত। আপন আপন গুরুর মহিমা যে কীর্তন করে সে-ই সর্বোত্তম নাম করে।
গুরুপূজার বা মাতৃপূজার বা দেবপূজার বিধান হল দেহ-ইন্দ্রিয়-প্রাণ-মনের ভিন্ন ভিন্ন অংশে ও তাদের ক্রিয়াকে বিভিন্ন বৃত্তির মধ্যে গুরুকে বা মাকে বা ইষ্টকে বসিয়ে গুরুভাব বা মাতৃভাব বা দেবভাব জাগ্রত করে নিতে হয়। তারপর বিশ্বদেহের মধ্যে নিজের দেহ এবং নিজের দেহের মধ্যে বিশ্বদেহ ভাবনার দ্বারা বিশ্বাত্মক আদিদেবের সঙ্গে নিজের তাদাত্ম্য ধ্যান করা হয়। তার ফলে বিশ্বচৈতন্যের সঙ্গে অভেদে মিলন হয়। এ-ই হল ব্যষ্টি আত্মার মুক্তির অন্যতম উপায় এবং সমষ্টি আত্মার সঙ্গে ব্যষ্টি আত্মার নিত্য, অভেদ ও অভিন্ন সম্বন্ধ স্ববোধে আবিষ্কার করা।

Capture

*গুরুর সান্নিধ্যে থেকে ধ্যান করা বিধেয় –

ধ্যান সর্বদা গুরুর নির্দেশে এবং গুরুর সান্নিধ্যে করতে হয়। গুরু কাছে থাকলে তিনি শিক্ষার্থীর সুবিধা-অসুবিধা বা প্রয়োজন সম্বন্ধে অবহিত হতে পারেন। দূরে থাকলে তাঁর নির্দেশ শিষ্য সব সময় বুঝতে পারে না। যদিও গুরু একজন বলেই স্বীকার করা হয়, কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে শিষ্যের মান ও চাহিদা অনুসারে সচ্চিদানন্দঘন অখণ্ড ভূমা এক গুরুর বিভিন্ন অভিব্যক্তির প্রয়োজন হয়। প্রত্যেক গুরুর কাজ এবং তাঁর অনুগামীর সংখ্যা নির্দিষ্ট করা থাকে।

Capture

আত্মদর্শনের বা গুরুদর্শনের তাৎপর্য –

নিজের ভিতরে ইষ্টকে জানা ও দেখা হল আত্মদর্শন এবং গুরুর মধ্যে নিজেকে জানা ও দেখা হল গুরুদর্শন। নিজের ভিতরে নিজেকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এই দেহই সব নয়। সমস্ত পৃথিবীই হল আমার দেহ। তারপর পৃথিবীও লয় হয়ে যায় এবং তখন যিনি থাকেন তাঁর নামই পরমাত্মা। তিনিই জীবাত্মা সেজে খেলেন।
সদ্‌গুরু ও জ্ঞানী-গুণীর সাথে থাকলে তাঁদের প্রভাব, গুণের স্পন্দন অলক্ষ্যে অযাচিত ভাবে আপনিই জিজ্ঞাসুর হৃদয়ে ফুটে ওঠে। তাঁদের কাছে চাইতে হয় না। যেমন আগুনের কাছে থাকলে আগুনের তাপ সহজেই পাওয়া যায়, চাইতে হয় না, সে রকম সৎ-এর প্রভাব আপনিই আসে, চাইতে হয় না।

Capture

গুরুর মহিমা –

গুরুকে মাধ্যম করেই ঈশ্বরীয় সত্তা বা অন্তঃসত্ত্বার শিক্ষা-দীক্ষার যা-কিছু অভিব্যক্তি বা বিকাশ হয়। গুরুর তুষ্টিতেই পরমাত্মা তুষ্ট। গুরু-ইষ্টের মহিমা অনাদি, অনন্ত – কোথাও তার সীমা খুঁজে পাওয়া যায় না। কালের সীমা দিয়ে গুরুর মহিমাকে খর্ব করা যায় না। কালও গুরুশূন্য বা সত্তাশূন্য নয়। কাল গুরুর বেশ। মহাকাল হলেন গুরু স্বয়ং। মহাকাল ও পরম শিব অভেদ। গুরুকে তাই পরম শিবও বলা হয়। তাইতো ভক্ত-সাধকের গানে পাওয়া যায় –[read more=”Read More…” less=”Read less”]‘আমি গুরুর চরণ ধরে রেখেছি
কালাকালের কী আর ভয় রেখেছি?’
গুরুকে যে ধরে, কাল তাকে গ্রাস করতে পারে না; বরং কাল তার পায়ে লুটোপুটি খায়। মৃত্যুভয়ে সে তখন আর অভিভূত হয় না। মৃত্যুর প্রতি উদাসীন থাকা হল গুরুভাব এবং মৃত্যুভয়ে ভীতভাব হল লঘুভাব। অভী না-হলে ভক্তি হয় না। ভয় দিয়ে ভক্তির সাধনা হয় না। শুদ্ধা ভক্তিতে ও শুদ্ধ জ্ঞানে ভয় বলে কোনও জিনিস থাকে না। সবার মধ্যে তিনি আছেন, তিনিই সবার কেন্দ্রসত্তা – এই তত্ত্ব প্রকাশ করে সাধককে সাধনার প্রথমেই নির্ভয়তার আশ্বাস দেন সদ্‌গুরু। যারা গুরু-ইষ্টকে ভজনা করে না বা মানে না তাদেরই ভয় থাকে।[/read]

Capture

*গুরুভাব –

নিজের ভিতরের পরিচয় জানলে গুরু-ইষ্টকে সর্বদা সর্বত্র দেখা যায়। কারণ তিনিই সব হয়ে আছেন। যাঁকে পাবার জন্য সাধনা করা হয়, তিনি সবার অন্তরে সবাইকে ধরে বসে আছেন।
গুরু হলেন সংকর্ষণ। ঈশ্বরের প্রথম ভাব হল গুরুভাব। গুরু ছাড়া কিছু প্রকাশ হতে পারে না। সংকর্ষণ অর্থ যিনি সমানের প্রতি আকর্ষণ করেন; অথবা সমত্বের মধ্যে যিনি নিজেকে প্রকাশ করেন। বোধসত্তা সমানে প্রতিষ্ঠিত। বোধগুরু ও বাসুদেব অভেদ। গুরু-ইষ্টের রূপই জগৎরূপে প্রকাশমান – নিত্য এই ভাবনায় যুক্ত থাকলে গুরুতাদাত্ম্য অনতিবিলম্বেই হয়।
গুরু ছাড়া কোনও কিছুর সত্য ও দিব্য মহিমা ব্যক্ত করা যায় না। ইষ্টের সঙ্গে মিলন হয় গুরুর মাধ্যমে। গুরু ও ইষ্ট অভেদ।
গুরুবরণের পদ্ধতি যুগে যুগে পরিবর্তিত হয়। নিজের আমিকে গুরুর চরণ বলে মানা হল অন্যতম বিশেষ পদ্ধতি। নিজেকে, গুরুপ্রদত্ত মন্ত্রকে এবং গুরুকে অভেদ ভাবনা করলে অল্পকালের মধ্যেই সর্বোত্তম ফল গুরুতাদাত্ম্য লাভ হয়।

Capture

নির্বাসনা হলেই গুরুকৃপা বোঝা যায় –

মনকে গুরু, ইষ্ট, মা বলা যায় তখনই, যখন মনের সব চাওয়ার অবসান হয়। মনের চাওয়া যতক্ষণ থাকে, ততক্ষণ বাইরের গুরু তার না-চাওয়ারূপ বৃত্তি প্রকাশের অপেক্ষায় থাকেন। যখন চাওয়া বন্ধ হয়, তখনই তাঁর কাজ আরম্ভ হয়। না-চাওয়া দিয়ে চাওয়াকে পূরণ করেন। অর্থাৎ সূক্ষ্মের জ্ঞান দিয়ে স্থূলকে পূরণ করেন বা অজ্ঞানকে সরিয়ে নেন। আবার যখন অজ্ঞানকে দেন বা স্থূল বস্তুর অভাব পূরণ করেন তখন জ্ঞানকে সরিয়ে নেন।
সদ্‌গুরুগণ শিষ্যসাধকের কোন চিন্তায় বা কর্মে বাঁধা প্রধান করেন না কারণ তাঁরা জানেন সময় হলে যাকে টানার তিনি তাকে টেনে নেবেন।

Capture

সদ্‌গুরুর পরিচয় –

অন্তরে-বাইরে অখণ্ড সত্যের পূর্ণ পরিচয় লাভ করে যিনি অপরকে তার সাধন বলে দেন তিনিই সদ্‌গুরু।
যিনি আত্মগান লাভের উপায়ের বা স্বরূপের সন্ধান দিয়ে দেন তাঁর নামই সদ্‌গুরু। যিনি মৃত্যুলোক থেকে অমৃতলোকে নিয়ে যান বা বিকার থেকে নির্বিকারে নিয়ে যান বা সসীম, ক্ষুদ্র আমিবোধ থেকে অখণ্ড, ভূমা, অসীম আমিবোধে যুক্ত করে দেন তাঁর নামই সদ্‌গুরু। যিনি ঈশ্বরের সঙ্গে, আত্মার বা ইষ্টের সঙ্গে পরিপূর্ণরূপে যুক্ত করে দেন তাঁর নাম সদ্‌গুরু। সদ্‌গুরু হলেন অজ্ঞান অন্ধকারে একমাত্র আলোর দিশারী। তাঁর আলো বিশুদ্ধ বোধের আলো, তা একমাত্র আত্মাকে অবলম্বন করেই পাওয়া যায়।
গুরু-মহাত্মারা স্বেচ্ছায় যা প্রকাশ করে দেন তা-ই তাঁদের শ্রেষ্ঠ কৃপা ও আশীর্বাদ।

Capture

*আত্মগুরু আশ্রিত জীবকে সাক্ষিদ্রষ্টা শিব বানিয়ে দেন –

বোধরূপী হরি বা মা বা গুরুই ছোট বড় সমস্ত জীবের মধ্যে বসে তার সর্বক্রিয়া সম্পাদন করেন। তাই দীক্ষার সময় গুরু বলে দেন – ‘আজ থেকে তোর যা-কিছু আছে – দেহ-প্রাণ-মন-বুদ্ধি, সব কিছুর মালিক আমি। তোর মধ্যে বসে যা করবার আমিই করব; সব দায়িত্ব আমার। তুই শুধু সব সঁপে দিয়ে আনন্দে, মজায় থাক’। এতখানি আশ্বাস এবং অমৃতের সন্ধান দিয়ে তাঁরা প্রত্যেককে অমৃতের কোলে বসিয়ে দেন। তখন জীবের আমি কর্তা-ভোক্তা-জ্ঞাতা নয় – তখন সে হয়ে যায় শিবের আমি অর্থাৎ সাক্ষিদ্রষ্টা মাত্র। ভগবান নিজেই গুরু সাজেন, আবার নিজেই শিষ্যসন্তানরূপে আসেন।

Capture

নাম, বীজ, মন্ত্র ও গুরু অর্থবোধক –

গুরুকে যদি কেউ ভালবাসে, সে যেন নামকে না-ছাড়ে। গুরুকে ভালবাসতেই হয়। কারণ তিনিই সব। যারা নাম পায়নি তারা যে কোনও একটি ঈশ্বরীয় নাম, যেমন ‘ওঁ রাম’ বা ‘ওঁ হরি’ জপ করতে পারে। এখানে বিশেষ নামের কথা কাউকে বলা হয় না।
মন্ত্রের সঙ্গে সুর বেঁধে দেওয়া আছে। যার যা নাম বা মন্ত্র তা আপনা থেকেই ওঠে। গুরু আছেন প্রত্যেকের আমির কেন্দ্রে। বাইরের সব গুরুই সেই এক গুরুর প্রতিচ্ছায়া। যারা ‘সোহ্হং’ উচ্চারণ করে তারাও একটা নামই উচ্চারণ করে। ‘আমিই সেই’ বলে অহংকার করে না। নামকে ‘সোহ্হং’ নাম দিয়ে তাঁর চরণে নিবেদন করে।

Capture

দীক্ষিতদের প্রতি গুরুভজনের নির্দেশ –

যারা দীক্ষিত তাদের বিশেষ করে বলছি যে গুরু, গুরুপ্রদত্ত বীজ বা মন্ত্র, ইষ্ট ও নিজেকে তোমরা অভেদ অখণ্ড বলে মেনে নিও। গুরুবোধে সব কিছুকে মেনে নেবার নাম সাধনা। নিজেকে গুরুর থেকে আলাদা ভাবলে গুরু কষ্ট পান এবং তাঁর কৃপাও অন্তরে অনুভব করা যায় না। ফলে নিজেকেও কষ্ট পেতে হয়।

Capture

গুরুর অতুলনীয় মহিমা –

গুরু একাধারে যেমন কঠোর ও দৃঢ় হন অপর দিকে তিনি তেমনই কোমল ও স্নেহঘন। এই দ্বিবিধ অভিব্যক্তি তাঁর স্বভাবের বৈশিষ্ট্য বলেই তাঁর মহিমা অতুলনীয়। তিনি চার হাতে শক্তি-জ্ঞান-আনন্দ-প্রেম বিতরণ করেন। এই কারণেই মা, শিব, নারায়ণ, ব্রহ্মা প্রভৃতি রূপের মধ্যে চার হাত দেখানো হয়।
হৃদয়ে অশুদ্ধ জিনিস বেশিক্ষণ থাকতে পারে না। হৃদয়ের কাজই হল সকলকে গ্রহণ করে শুদ্ধ করা। সেই জন্য গুরু কাউকে বাদ দিতে পারেন না। শ্রেষ্ঠ বস্তুকেই গুরু বলা হয়। প্রিয়তম বলে গুরু আপন। জ্ঞানঘন বলে গুরু অখণ্ড।

Capture

দীক্ষার পরিণাম সমবোধ বা আপনবোধ –

গুরু শিষ্যকে তৈরি করে শিষ্যের মধ্যে মিশে যান; অথবা গুরুবাক্‌, সত্যবাক্‌ ও আত্মবাকের সঙ্গে মনের কথা মিলিয়ে নিয়ে শিষ্য গুরুমনা ও আত্মমনা হয়ে যায়। এর নামই বোধের পূজা।
সর্বকর্মের ফল গুরুর নামে রাখলে নিজে মুক্ত থাকা যায়। শিবরূপী গুরুর বাণী হল – “তোর আমির মধ্যে আমি বসে আছি। তোর আমিকে দিয়ে সেই ‘আমি’-কে মান্‌ ও জান্‌।” এ-ই হল আসল দীক্ষা। প্রত্যেকের আমির কেন্দ্রে যিনি আছেন, তিনিই হলেন গুরু বা ইষ্ট।
অমৃত রয়েছে সদ্‌গুরুর মধ্যে। মৃত্যু রয়েছে অমৃতের মধ্যে বা সদ্‌গুরুর মধ্যে। বোধস্বরূপ গুরু প্রীত হলেই অমৃতের আস্বাদন হয়। সমতা হল অমৃত ও অসাম্য হল মৃত্যু।

Capture

দিব্যমানবদের অভিনব আচরণ ও অনুশাসন –

যাঁরা বিকার শোধনের বিজ্ঞান অধিকারীভেদ বিবেচনা না-করে সকলকে সমান ভাবে ধরিয়ে দিয়ে যান, তাঁরা জগতে দিব্যমানব বলে পরিচিত। এক নিত্যবস্তুর মধ্যে বড়-ছোট বা অধিকারী-অনধিকারী এরূপ ভেদ করেন না তাঁরা।
গুরুপ্রদত্ত প্রজ্ঞার আলো নিয়ে জীবনে চলতে হয়। গুরুমুখে পুনঃপুনঃ সদালোচনা বা তত্ত্বালোচনা শুনেই পুরুষোত্তমের বিজ্ঞান পাওয়া যায়। তা ছাড়া আর কোনও সহজ পথ নেই।

Capture

গুরুচরণেই সর্বসিদ্ধি অধিষ্ঠিত –

কী সুন্দর এই উপাখ্যানটি! সর্বতীর্থ ঘুরে শিষ্য দেখল যে পূর্ণতা কোথাও নেই। পূর্ণতা আছে শ্রীগুরুর চরণে। ‘আমার-আমি’-কে শুধু গুরুই নিতে পারেন। দেবতারাও নিতে পারেন না। ‘গুরু’ কিন্তু একজন ব্যক্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ নন। ইন্দ্রিয়ের বাইরে ও ভিতরে, অনুভূতির মধ্যে যা-কিছু উপস্থিত হয় সবই আত্মবোধরূপ গুরুরই স্পন্দিত রূপ বা লীলায়িত রূপ। তা সম্যক্‌ রূপে মনে রেখে আত্মব্যবহার সাধন করতে পারলে গুরুর কৃপা প্রত্যক্ষ ভাবে অনুভব করা যায়।

Capture

হৃদয়েতে নামের স্ফূর্তি হলে ভাবস্ফূর্তি হয় –

নাম দিয়ে রূপকে ব্যবহার করতে হয়। নাম যেন স্বতঃস্ফূর্ত হয়। তাহলে মধুরভাব আসে। এই ভাব গাঢ় হলে হয় ভাবশুদ্ধি অর্থাৎ স্বভাবের স্ফূর্তি। তাই হল নিত্যের মধ্যে লীলা এবং লীলার মধ্যে নিত্যস্থিতি। অথবা বলা যায় বোধের মধ্যে মন এবং মনের মধ্যে বোধ। আমার মধ্যে গুরু আছেন এবং গুরুর মধ্যে আমি আছি। এই অভিন্ন বোধে ভয়, সংশয় ও ভেদজ্ঞান চিরদিনের মতো লুপ্ত হয়। বোধসত্তাই স্বয়ং গুরু।
‘আমি তাঁর মধ্যে এবং তিনি আমার মধ্যে’ অথবা ‘জীবের আমির মধ্যে শিবের আমি’ এবং ‘শিবের আমির মধ্যে জীবের আমি’, এই অদ্বয়বোধের বৃত্তি চক্রাকারে খেললে গুরুর সঙ্গে তাদাত্ম্য লাভ হয়। তখনই হয় “তত্ত্বমসি”-র মর্মার্থ সিদ্ধ।

Capture

সদ্‌গুরুর বাক্যে ব্যবহার–অনুরূপ ফললাভ –

সদ্‌গুরুরবাক্য গ্রহণ করার উপরে তার ফল নির্ভর করে। অংশমাত্র গ্রহণ করলে বা সিকিমাত্র গ্রহণ করলে এক এক রকম ফল পাওয়া যায় এবং পূর্ণাঙ্গ গ্রহণ করলে পূর্ণাঙ্গ ফল পাওয়া যায়।

Capture

রুর শিক্ষা –

গুরুওই শিষ্যকে অন্তর্মুখী হওয়ার জন্য বারবার নির্দেশ দেন। শিষ্যকে বলেন – নিজেকে দেখ। অন্তরের গভীরে যাও, আরও গভীরে। রূপের গভীরে আছে নাম, নামের গভীরে ভাব, ভাবেরও গভীরে আছে বোধস্বরূপ স্বয়ং। আপন আপন গুরুর নাম নিয়ে একের পর এক স্তর ডুব দিয়ে একেবারে গভীরে চলে যাও। যদি কেউ মন্ত্র না-পেয়ে থাকো, শুধু ‘তুমি’ বলে ডুব দাও। হলদে রংকে হলদে রং বলার মধ্যে কি মন্ত্র চৈতন্য খেলে গো ? মাকে যে ‘মা’ বল শৈশব থেকে কে তা শিকিয়ে দেয় ? ‘এ’ (নিজেকে দেখিয়ে) কোনও দলে থাকে না, থাকে শুধু সহস্র দলে বা একদলে। ‘এর’ কাছে ‘সহস্র’ অর্থ হল – ‘সহরূপ অস্র’ বা ‘সহরূপ অস্রের’ মধ্যে থাকা। তাই তো বলা হয় – ‘যে সয়, সে-ই রয়’। যে সয় না তার নাশ হয়। সহ্য হল ধ্যান। যা-কিছু আশুক স্থির হয়ে দেখতে হয়। অন্তরে স্থির না-হলে নামজপ বা ধ্যান হয় না। কিছুক্ষণ এখানে চুপ করে বসে থাকার উদ্দেশ্য হল নিজেকে relax করে নিজেকে দেখা। বাইরে নূতন করে কিছু জানার নেই। প্রতি মুহূর্তে সে নিত্য নতুন রূপ পালটে চলেছে; কারণ তার রাগ-রাগিণীর সুর মূর্ছনার শেষ নেই।
শাস্ত্রের গলদগুলি বলে দিয়ে না-গেলে মানুষকে চিরকাল ভুলের মধ্যেই ঘুরে মরতে হয়। সদ্‌গুরু মহাপুরুষগণ শাস্ত্রের অর্থ বলে দিয়ে যান। নইলে অনর্থের মধ্যে মানুষকে থাকতে হয়। অনর্থ নিবৃত্তি তার আর হয় না।

Capture

সদ্‌গুরুর কাজ –

সদ্‌গুরুর শিষ্যের সংসয় ও সন্দেহ দূর করেন, তাকে নানা ভাবে অদ্বয়বোধে অনুপ্রাণিত করেন। তিনি তাকে বলেন – তুমি নিত্য, শুদ্ধ, বুদ্ধ, মুক্ত, অজর, অমর, অপাপবিদ্ধ। কে তোমাকে বাঁধবে? নিজের আসল স্বরূপ ভুলে গিয়ে তুমি নিজেকে কেন বদ্ধ ভাবছ?
গুরুপ্রদত্ত নাম ও বীজ ছাড়া আর কারুর প্রতি আশক্তি বা ভালবাসা থাকা উচিত নয়, এমনকী নিজের দেহের প্রতিও নয়। দেহ তো বিনাশী যেকোনো সময় দেহের নাশ হতে পারে। দেহের মধ্যে দেহীরূপে যিনি আছেন এবং প্রতিটি মানুষের মধ্যে ‘আমি-আমি’ বোধে ফুটে ওঠেন সেই ‘অখণ্ড ভূমা আমিবোধ’-ই হল সকলের যথার্থ স্বরূপ। এই ‘ভুমা আমি’ হল শুদ্ধ বোধস্বরূপ। এছাড়া আর সবকিছুই প্রতিভাস। প্রত্যেক মানুষের মধ্যে ‘আমি-আমি’ প্রত্যয়রূপে যা ফুটে ওঠে তা হল খণ্ড আমি বা কাঁচা-আমি বা অহঙ্কারের আমি। তা দেহাত্মবোধ ‘আমি’ – অখণ্ড ভূমা আমির প্রতিভাস মাত্র। তা বিকারী ও ক্ষণস্থায়ী।

Capture

সৎসঙ্গের ফল কী ভাবে কার্যকরী হয় –

সৎসঙ্গে ধ্যানে বসে গুরুপ্রদত্ত বাণীগুলি স্মরণ করতে হয়। গুরুর সব নির্দেশ পালনে অক্ষম হলে তাকেই বিনম্র ভাবে জানাতে হয় – আমি কিছুই তো পারছি না। তুমি যা হয় একটা ব্যবস্থা কর। সৎসঙ্গের সময় অন্য চিন্তা আথায় ঘুরলে সৎসঙ্গের ফল নষ্ট হয়ে যায়। সেই জন্য সৎসঙ্গে প্রবেশ করার নিয়ম হল নানাবিধ সমস্যা ইত্যাদি দরজার বাইরে রেখে প্রবেশ করার এবং মনে এই বিশ্বাস রাখতে হয় যে গুরু আমার অন্তরের সবকিছুই দেখছেন। তাঁকে ফাঁকি দেবার উপায় নেই।

Capture

গুরুর সঙ্গে নিজের পৃথক ভাবনাই হল পাপ –

পাপ বলে যদি কিছু থাকে তা হল গুরুকে নিজের থেকে এবং নিজেকে আত্মগুরুর থেকে পৃথক ভাবনা করা। তা-ই বিকার সৃষ্টি করে। নিজের থেকে আত্মগুরুরকে পৃথক না-ভাবলে পাপ হয় না; এবং তখনই সচেতন হওয়া যায়। সচেতন হলে গুরুসঙ্গ বা সৎসঙ্গ করা হয়। অভেদ ভাবনা না-হলে অভেদ অনুভূতি বা অভেদ দর্শন হয় না। সদ্‌গুরু সবকিছুর মধ্যেই আছেন। তা না-হলে সদ্‌গুরু অখণ্ড হন না। তবে প্রথম অধিকারীর জন্য হরির বা গুরুর এক বিশেষ রূপ রাখতে হয়। বাল্য শিক্ষা নিয়ে জীবন কাটালে বোধের বিকাশ হয় না। সমগ্র সত্তা হল সদ্‌গুরুর স্বরূপ। সদ্‌গুরুর কাছে সব চাবিকাঠি থাকে। তিনি সন্তুষ্ট হলে খুলে না দিলে নিজের চেষ্টায় খোলা খুব কঠিন।
আপন গুরুপ্রদত্ত নাম হল সম্পদ। কেউই ভিখারী নয়। আসল বস্তু আছে সকলের ভিতরে।

Capture

*অহংকার-অভিমানে গুরুর কৃপালাভ হয় না –

Capture

গুরুসঙ্গ ও গুরুকৃপার তাৎপর্য –

যে বোধ অসৎ থেকে সৎ-এ, লঘু থেকে গুরুতে এবং সীমা থেকে অসীমে নিয়ে যায় তা-ই হল গুরুবোধ। যা অসীম থেকে বিভক্ত করে ইন্দ্রিয়ের দ্বারে নিয়ে আসে তা লঘুবোধ। লঘুবোধে হয় অশুদ্ধ ভক্তি। অশুদ্ধ ভাবকে শুদ্ধ করার উপায় যে-ভাবে পাওয়া যায় তাই গুরুকৃপা। যে ভাব ইন্দ্রিয়ের দ্বার থেকে টেনে কেন্দ্রগত এক-এর দিকে নিয়ে যায়, তাই গুরুভাব।
সদ্‌গুরুসেবা হল কেন্দ্রবোধের সেবা এবং লঘুর সেবা হল মনের পরিধির সেবা। ‘আমার ঠাকুর’ বললে ইন্দ্রিয়ের সেবা করে ইন্দ্রিয় চরিতার্থ হয়। ‘ঠাকুরের আমি’ বললে অখণ্ডের বোধ আসে। কোনও অভাব থাকে না।[read more=”Read More…” less=”Read less”]সৎসঙ্গের বিষয়বস্তু মনোযোগ সহকারে না-শুনলে সদ্‌গুরুর কৃপা পাওয়া যায় না। সদ্‌গুরুর বিধি-নিষেধগুলি পালন না-করলে ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বরও কিছু করতে পারেন না। গুরুশক্তির উপরে আর কোনও শক্তি নেই আবার গুরু ভাববোধের উপরেও আর কোন শ্রেয় ভাববোধ নেই। গুরুর এক অংশে বিরাজ করেন ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর। গুরুভজনে অতি নিকৃষ্টকেও মানতে হয়। তা না-হলে গুরুভজনের ফলস্বরূপ গুরুবোধের প্রকাশ হয় না।
অসৎকে ত্যাগ করে যে সত্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তার-ই হয়েছে যথার্থ সন্ন্যাস। কথার অর্থবোধ খেললেই পাওয়া যায় গুরুকৃপা। তখন অজ্ঞাত বস্তু জ্ঞাত হয়। অর্থাৎ যে কথার দ্বারা অজ্ঞানীর জ্ঞান হয় তাই গুরুকৃপা।[/read]

Capture

আধ্যাত্মিক বিবাহ কাকে বলে? এবং তার তাৎপর্য –

গুরুশক্তিকে বহন করার জন্য উপযুক্ত শিষ্যই দরকার। গুরুশক্তি বহন করা যায় তখনই, যখন অন্তরে ‘হংসঃ সোহ্হম্‌’ ধ্বনি নিরন্তর ধ্বনিত হতে থাকে। গুরুশক্তি বহন করে চললেই সংসার সমসারে পরিণত হয়। সেই শক্তি বহন করতে না-পারলে মানস সরোবরে বিরাজ করা যায় না বা হংসদেব হয়ে সোহ্হং মন্ত্রে প্রতিষ্ঠিত হয়ে মুক্তির আস্বাদন করা চলে না।
শয়নে-স্বপনে ও প্রতি শ্বাসে শ্বাসে যখন হংসধ্বনি বেজে ওঠে তখনই সে মানস সরোবরে পরমহংসরূপে বিরাজ করেন। হংসের রূপটি হল শুভ্র শ্বেতবর্ণ। প্রজ্ঞান হল তার মস্তক। জ্ঞান ও ভক্তি হল তার দুটি ডানা। প্রেম তার হৃদয়। অনাসক্তি হল তার পুচ্ছ। বিবেক-বৈরাগ্য হল তার চরণ। চৈতন্য হল তার পালক। শান্তি হল তার প্রাণ। আনন্দ হল তার মন। সমতা হল তার ধর্ম। প্রকাশ হল তার কর্ম। নিত্যবর্তমানতা হল তার ছন্দ। এই হল মোটামুটি পরমহংসের পরিচয়।

Capture

সদ্‌গুরুর দেহ হল transcendental –

ঈশ্বর হলেন গুরু। ঈশ্বর কী? তিনি হলেন জ্যোতিঘর্ন মূর্তি; মনুষ্যদেহকে অবলম্বন করে তিনি নেমে আসেন। মানুষ তার সত্যস্বরূপকে মানস হিসেবেই চায়। মনুষ্যরূপ ছাড়া অন্য কোনও রূপকে সে দেবতা হিসাবে গ্রহণ করতে পারেন না। ঈশ্বরের জ্যোতির রূপ অনেকে নিতে পারেন না। ওই অবস্থায় জীবের যন্ত্র বা ইন্দ্রিয় কার্যকরী হতে পারে না। ওই light নিয়ে আসার মত আধার খুব কম। ঈশ্বরের ইচ্ছা-ই কেবল সেখান থেকে নিম্নভূমিতে নেমে আসে, মনুষ্যরূপ ধারণ করে এবং অনেকদিন থাকে। তাঁকেই অবতার বলা হয়। অবতারদের দেহ পাঞ্চভৌতিক জাত দেখালেও তা ভাগবতীতনু। উত্তম প্রেমিক ভক্ত ছাড়া এ দেহের মর্ম অন্যের পক্ষে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। তাঁদের দেহ অপ্রাকৃত বা অতিপ্রাকৃত। শক্তির ভিন্ন ভিন্ন ভাগ আছে। শক্তিস্বরূপ দিয়ে গড়া তাঁদের দেহ। তা স্থূল শক্তির প্রভাবে পরিচালিত হয়। তাই বলা হয় সদ্‌গুরুর দেহ থেকেও নেই এবং না থেকেও আছে।

Capture

কৃষ্ণের বাঁশির ডাকের তাৎপর্য –

আকাশতত্ত্বের ঊর্ধ্বে যাঁর মন নিত্য প্রবিষ্ট তাঁর সমাধির জন্য আর চেষ্টা করতে হয় না। তাঁকে শান্তির জন্য কোনও কিছুর উপরে নির্ভর করতে হয় না। সেই শান্তি প্রত্যেকের হৃদয়ের গভীরে নিহিত থাকা সত্ত্বেও সাধনসিদ্ধির অভাবে ইচ্ছামাত্র তথায় কেউ যেতে পারে না। ধ্যানের মধ্যে সেই স্তরের একটুমাত্র স্পর্শও যদি কেউ পেয়ে আসে তবে তার মধ্যে এমন এক আনন্দের অনুভূত হয় যা কোনও মতেই আর ভোলা যায় না। এই স্মৃতি বারবার তাকে অন্তরের দিকে টেনে নিয়ে যায়। এ-ই হল কৃষ্ণের বাঁশির ডাক বা অন্তরের ডাক। এ-ই হল গুরুর টান, যে টানে সসীম থেকে অসীমে, রূপ ছেড়ে অরূপে মন চলে যায় এবং জগৎ ভুল হয়ে যায়।

Capture

গুরুতত্ত্বই হল সর্বতত্ত্বের সার –

গুরুভাব অনুমান করা খুব কঠিন। এক একজন সাধক এক এক ভাবের পর্যায়ে সিদ্ধিলাভ করে। সিদ্ধপুরুষের মধ্যেও অনেক প্রকার ভেদ আছে। নিত্যসিদ্ধ ও সাধনসিদ্ধ উভয়ে এক নয়। এ ছাড়া শক্তির সাধনায় সিদ্ধি, জ্ঞানের সাধনায় সিদ্ধি, যোগের সাধনায় সিদ্ধি, প্রভৃতিও সব এক পর্যায়ভুক্ত নয় এবং প্রত্যেকের লক্ষণও এক নয়।
এক ভাবের সঙ্গে পরিচিত হয়ে দীর্ঘকাল থাকার পর stagnant হয়ে বসে থাকে। পরে অন্য ভাবের সঙ্গে পরিচিত হয়ে সে অনেক উন্নতি করতে পারে। উন্নতি হলে সে মনে করে যে তার এই উন্নতি পূর্ব ভাবের দ্বারাই হয়েছে। পুরনো ভাবের ধারণা নিয়ে চলে বলে নূতন ভাবের ধারা ব্যাহত হয় অকৃতজ্ঞতার জন্য।
অভাববোধে সাধনা করতে করতে কৃতজ্ঞতা ও অকৃতজ্ঞতা বোধ পাশাপাশি জেগে ওঠে। অকৃতজ্ঞতাবোধে তার নিচে আসতে হয়। এগুলি খুব গোপন তত্ত্ব বলে গুরুরা প্রকাশ করেন না।

Capture

ভগবানের কাজ গুরুর মাধ্যমে সিদ্ধ হয় –

পরমশিব, পরব্রহ্ম ও পরমেষ্ঠিগুরু একই। এই শিবস্বরূপ হল প্রত্যেকের নিত্যস্বরূপ। নিত্য হলেই তা অখণ্ড ও সৎ শব্দ দ্বারা চিহ্নিত হয়। নিত্য, জ্ঞান ও আনন্দ – এই তিনটি শব্দ দ্বারা যাকে বোঝায় তিনিই হলেন পরমেষ্ঠিগুরু, পরব্রহ্ম ও পরমেশ্বর। তিনিই কিন্তু তাঁর অনন্ত শক্তির মাধ্যমে ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বররূপে লীলা করেন। সব দেবদেবী তাঁরই প্রকাশ। তাদের অন্তর্গত অনেক অনেক বিভাগ আছে। আবার তাদের অন্তর্গত আহে জ্ঞান। মানুষ গুরুকৃপায় প্রতি স্তরের পরিচয় অবগত হয়। ভগবান গুরুর মাধ্যম ছাড়া কাজ করতে পারেন না। আগে গুরু সেজে নিজে নেমে আসেন, তারপর সেই মাধ্যমকে অবলম্বন করে তাঁর পূর্ণতার প্রকাশ হয়। গুরুগত চিত্ত, ঈশ্বরগত চিত্ত, জ্ঞানের সাধক, যোগী প্রভৃতি সকলেরই লক্ষ্য এক অখণ্ড জ্ঞানস্বরূপের সঙ্গে একভূত হয়ে যাওয়া অর্থাৎ নিজের পূর্ণস্বরূপে প্রতিষ্ঠিত হওয়া।

Capture

গুরুর হাতেই শিষ্যের যোগ্যতার মাপকাঠি ধরা থাকে –

ঋষি যুগে ঋষিগণ গুরুবাক্য বিশ্বাস করে ও তদনুরূপ সাধন করে আত্মসিদ্ধি ও মুক্তি লাভে ধন্য ও কৃতকৃত্য হতেন। কিন্তু বর্তমান যুগের মানুষ বিনা সাধনায় সিদ্ধি ও পূর্ণতার ফল পেতে চায়। এই প্রসঙ্গে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কথা হল যে সাধনসিদ্ধির পরে প্রয়োজন অনুসারে গুরু শিষ্যকে বিশেষ ভাবে পরীক্ষা করতে পারেন, কারণ সিদ্ধির ব্যবহারে যাতে কোনও রকম দোষত্রুটি না-থাকে।
অনেক সময় শিষ্যের চরম যোগ্যতা পরীক্ষা করার জন্য তার সিদ্ধিলাভের পরেও গুরু শিষ্যের সিদ্ধির ঘরে চাবি আটকে দেন এবং যথাকালে বিশেষ পরীক্ষার পরে তা খুলে দেন। তখন শিষ্যের সম্মুখে আর কোনও অন্তরায় থাকে না; সহজ ভাবেই সে তার সিদ্ধি ব্যবহার করতে পারে। যে গুরু একই রকম শিষ্যকে তৈরি করেন, তিনিই যথার্থ গুরু। অনধিকারীর হাতে বড় অধিকার ছেড়ে দিতে নেই। অযোগ্যের হাতে দুর্লভ বস্তু পরলে অপব্যবহারের ফলে তা সাধারণত বিকৃত ও বিনষ্ট হয়। যোগ্যতা ও অধিকার জীবনের সর্বক্ষেত্রে বিশেষ ভাবে প্রয়োজন; আধ্যাত্মক্ষেত্রে তা বলাই বাহুল্য।

Capture

*সদ্‌গুরুকে নিজের মধ্যে এবং নিজেকে তাঁর মধ্যে ভাবনার ফল –

একান্ত অনুগত ভক্ত গুরুর নির্দেশেই চলে এবং গুরুভাবেই সব কিছু দেখে। নিজের খুসি মতো চললে যথার্থ ফল লাভ করা যায় না। ব্যষ্টিভাব থেকে সমষ্টিভাবে রূপান্তর গুরুর কৃপাতেই হয় সত্য; কিন্তু তা সাধকের ঐকান্তিক নিষ্ঠা ও চেষ্টাসাপেক্ষ। যিনি শিবস্বরূপ, অখণ্ড ভূমাস্বরূপ। তাঁর সম্বন্ধে যথার্থ ধারণা করা ব্যষ্টি জীবের পক্ষে প্রথমে সহজে সম্ভবপর হয় না। গুরুকে দেখে বিভিন্ন লোকের বিভিন্ন ভাব হয়। সবগুলি ভাবই গুরুর মধ্যে আছে। সদ্‌গুরু ও পরমাত্মা অভিন্ন বলে গুরু হলেন সর্বব্যাপী। গুরুর দেহ হল সর্বভাবের কেন্দ্র। এই ভাবনা দ্বারা আমি (ব্যষ্টি) সমষ্টির মধ্যে এবং সমষ্টি ব্যষ্টির মধ্যে প্রবেশ করে। অর্থাৎ ব্যষ্টি সমষ্টির সঙ্গে তাদাত্ম্যলাভ করে।

Capture

সিদ্ধপুরুষদের গুরুদক্ষিণা দানের তাৎপর্য –

গুরুর ঋণ শোধ করা যায় না। তাই সিদ্ধিলাভের পরেও সাধক গুরুর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের মাধ্যমে গুরুদক্ষিণা দেন। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন তিনি প্রার্থনা ও গুরুস্তব ও স্তুতির মাধ্যমে – ‘তুমি মহান্‌ অনন্ত অসীম। আমি ভাল বা মন্দ যা-ই হই না কেন তোমার কৃপাতেই আমি এই অবস্থা লাভ করেছি’। গুরুর কাজ হল – আপনবোধে বা সমবোধে মানা। কী ভাবে যে সবকে মানা সম্ভবপর হয় তা তাঁদের আচরণ না-দেখলে বোঝা যায় না। মহাত্মা-মহাপুরুষদের জীবনে এ রকম বহু দৃষ্টান্ত দেখা যায়।

Capture

গুরুবাকের মর্ম –

গুরুবাক্‌ই হল অক্ষরব্রহ্ম। অক্ষর = বাক্‌-এর স্বর অর্থাৎ চৈতন্যের বীজ। তা অতীন্দ্রিয় বলে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়। অথচ এর দ্বারাই ইন্দ্রিয়বর্গ পরিচালিত হয়। এ-ই হল মুখ্যপ্রাণ বা জীবচৈতন্য এবং স্বররের ঘনীভূত মূর্তি। এর থেকেই স্বর উদ্গীত হয়।

Capture

গুরুর ব্যবহার –

গুরুর ব্যবহার হল স্ববোধের ব্যবহার এবং তার ফল হল স্ববোধের মধ্যে স্ববোধের অনুভূতি। তাঁর রূপ হল ‘স্বসংবেদ্য স্বানুভূতি কেবলম্‌’ – সৎ-চিৎ-আনন্দ। ‘সৎ’ মানে যা সব কিছুকে প্রকাশ করেও নিজের অস্তিত্বকে সমান ভাবে রাখে এবং যা কার্য-কারণ-কাল দ্বারা পরিবর্তিত হয় না ও নিত্য নির্বিকার হয়েও সব কিছুকে প্রকাশ করে। সেই ‘সৎ’ হল প্রকাশময়। তা-ই তার ভাতি রূপ বা চিৎ। সৎ ও চিৎ এই দু’য়ের যে যুগল রূপ তা হল আনন্দ। আনন্দ সৃষ্ট বস্তু নয়। তা নিত্যবস্তু ও স্বতঃস্ফূর্ত; ক্রিয়াসাপেক্ষ নয়। ‘স্বসংবেদ্য স্বনুভূতি’ হল – যে অনুভূতি সব কিছুকে প্রকাশ করেও নিজে যেমন ছিল তেমনই থাকে।

Capture

গুরুশক্তির অভিনব মহিমা –

গুরুশক্তি মানে সেই জীবন যা তপস্যার মাধ্যমে পরিশোধিত হয়ে অখণ্ড ভূমার সঙ্গে একভূত হয়েছে। তাঁর মুখনিঃসৃত বাণী সর্বাপেক্ষা কার্যকরী হয় কারণ সেই বাণীর ভিতরে দেবলোক, ঋষিলোক, পিতৃলোক, গন্ধর্বলোক ও সিদ্ধলোকের শক্তি এবং এই সমস্ত লোকের অধিষ্ঠানচৈতন্য ও তার শক্তি সবই যুক্ত থাকে। ত্রেতায় তপস্যার অংশ কিছু কম। দ্বাপরে ও কলিতে তা আরও কম। সেই অভাবকে পূরণ করে দেন সদ্‌গুরু স্বয়ং। সেই জন্য সদ্‌গুরুর করুণা ও অবদানের কোনও সীমা পরিসীমা নেই।
মনুষ্যজীবনে মানুষ কায়মনবাক্যে বহু দোষত্রুটি করে। ত্রুটি হল যা স্বকীয় বুদ্ধিদোষে নিজেকে অখণ্ড থেকে পৃথক করে শুধু নিজের ব্যক্তি রূপ বা আমি রূপ দেহপ্রীতির জন্য যে কর্ম করা হয় তা। তা ভ্রান্তিমূলক। তপস্যার মাধ্যমে এই ত্রুটি দূর হয় এবং গুরুবাণী ধারণের শক্তি হয়। কারণ চিত্ত শুদ্ধ না-থাকলে গুরুবাণী শুনলেই ধারণা করা যায় না। সেই জন্য গুরুগণ তাঁদের অনুভবকে ব্যক্ত করার সঙ্গে সঙ্গে কতগুলি নির্দেশ দেন যা বিধি ও নিষেধ রূপে প্রচলিত। গুরুর আদিষ্ট সাধন ও তার বিধি-নিষেধ পালন করে চলা হল তপস্যা।

Capture

গুরুকৃপায় ঈশ্বরলাভ হয় –

মহাপ্রভু নিত্যানন্দকে বলেছিলেন – তুমি যদি কৃপা না-কর তবে আমার কৃপা পৌঁছবে না। গুরুবেশে ভগবানের কৃপা বেশি ফলপ্রদ হয়। গুরুভাবে নিত্যানন্দরূপে ভগবান এসেছিলেন, তা process নয়, principle । Universal কৃপা না-করলে Transcendental-এর কৃপা পাওয়া যায় না। মহাপ্রভু হলেন Transcendental এবং নিত্যানন্দ হলেন তাঁর first manifestation। প্রাণের গতিই নানা রকম বৈচিত্র্যময় ভঙ্গিমায় ব্যষ্টিরূপ ধারণ করে প্রকাশিত হয়ে চলেছে। তাঁর সমষ্টি গতি হল নারায়ণ বা মহাপ্রাণ।

Capture

গুরুর তাৎপর্য ও মহিমা –

গুরু পুনঃপুনঃ আত্মা সম্বন্ধে সচেতন করে দেন এবং শিষ্যের জট খোলায় সাহায্য অর্থাৎ মনের সংশয় দূর করতে সাহায্য করেন। যে জট পাকিয়ে আছে তা খোলার জন্য গুরুপ্রদত্ত আলো যদি কেউ ব্যবহার করতে না পারে তার জন্য পর্যায়ক্রমে নির্দেশগুলি সাজিয়ে দেন। গুরু এমনভাবে আপন অনুভূতির আলো দেন যা শুনে অপরেরও অনুভূতি খেলে এবং যার দ্বারা অপরের অনুপ্রাণিত বা উদ্বুদ্ধ বা প্রবোধিত হয়, এই হল গুরুপ্রদত্ত জ্ঞান। এই জ্ঞানের একটি সমষ্টি রূপ বা একটি অসীম রূপ আছে। সেই রূপকেই ইষ্ট বলা হয়। এই রূপটি সকলের কাছে অতন্ত প্রিয়। তা প্রকাশিত হবার সঙ্গে সঙ্গে আলোকিত হয়ে যায় সব-সকলের মধ্যে থাকা সত্ত্বেও তা আবৃত হয়ে আছে। যেমন বাড়িতে প্রতি ঘরে ঘরে আলো জালানো থাকা সত্ত্বেও ঘরের দরজা যদি বন্ধ থাকে বাইরে থেকে সেই আলো দেখা যায় না। সে ক্ষেত্রে দরজা খুলে ঘরে প্রবেশ করতে হয়। সে রকম প্রত্যেকের হৃদয়াকাশে প্রজ্বলিত এই জ্ঞানালোক উদ্ভাসিত হওয়ার জন্য হৃদয়দ্বারও উন্মুক্ত করতে হয়। গুরুপ্রদত্ত জ্ঞানের সাহায্যে সহজে হৃদয়দ্বার উন্মুক্ত হয়।

Capture

সদ্‌গুরুর ভাববোধই জীবের সাধ্য, সাধন ও সিদ্ধি –

সদ্‌গুরু হলেন পরমাত্মবোধের অভিব্যক্তি। তাঁর কাঝল জীবের বন্ধনের কারণে আত্মবোধের জ্যোতির দ্বার সরিয়ে দেওয়া। এরই নাম হল জ্ঞানাঞ্জনশলাকা বা spiritual fire বা আত্মবোধের অনুভূতির বিজ্ঞান।

Capture

গুরু হলেন সকলের আত্মা স্বয়ং –

“ব্রহ্মানন্দং পরমসুখদং কেবলং জ্ঞানমূর্তিং
দ্বন্দ্বাতীতং গগনসদৃশং তত্ত্বমস্যাদিলক্ষ্যম্‌
একং নিত্যং বিমলমচলং সর্বধীসাক্ষিভূতং
ভাবাতীতং ত্রিগুণরহিতং সদ্‌গুরুং তংনমামি”[read more=”Read More…” less=”Read less”]গুরুবাক্যের মধ্যে এমন শক্তি আছে যা শিষ্যের অন্তরে প্রবেশ করে তার সমস্ত মলিনতা দূর করে অর্থাৎ মনের অশুদ্ধ ভাবকে দূর করে শুদ্ধ মন তৈরি করে দেয়, যার দ্বারা সে নিজের অখণ্ড স্বরূপের অনুভূতি লাভ করতে পারে। গুরুবাক্‌ হল পরাবাক্‌ বা ইষ্টের বাণী যাকে কেউ খণ্ডন করতে পারে না।[/read]

Capture

সদ্‌গুরুর উদ্দেশ্য হল শিষ্যের অন্তরে অনন্ত অনন্ত জন্মের সংস্কার বা মল শোধন করা। –

গুরু অনেক ভাবেই সাহায্য করেন। ইষ্টদর্শনের রাস্তা গুরু ছাড়া আর কেউ পরিষ্কার করে দিতে পারেন না তবে মনুষ্যবোধে গুরুকে নিলে আসে অভিমান। গুরুর প্রতি আসে সংশয়, সন্দেহ ও নিষ্ঠার অভাব। অনন্ত জীবনের অনন্ত সংস্কার জমা থাকে। তার মধ্যে সামান্য কিছু কার্যকরী হয়েছে বর্তমান জীবনে। শুধু এই জন্মের সংস্কার থেকে রেহাই পেলেই হয় না। যত রকম মল বা সংস্কার জমে আছে সবকিছু শোধন করে দেওয়াই হল গুরুর লক্ষ্য। এই সংস্কারের জন্যই মানুষকে একবার উপরে ও একবার নিচে নামতে হয়। সেই সব সংস্কারকে গুরু নাশ করেন।[read more=”Read More…” less=”Read less”]সৎসঙ্গে যেমন শ্রবণ তেমন গ্রহণ হলে বিকার থাকতে পারে না। অন্যরূপ হলেই আর উপায় থাকে না। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে যে বশিষ্ঠদেব শ্রীরামচন্দ্রকে বলেছিলেন – “বারবার যেমন বলছি তেমন ভাবে যদি অনুসরণ করতে না-পার, যতই তুমি দেবতা হয় কিছুতেই আত্মস্বরূপে প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে না।”
যে বিজ্ঞান কখনো বিকৃত হতে পারে না ব্যক্তি বিশেষের দ্বারা বা তার ব্যবহার দ্বারা কলুষিত হতে পারে না। সেই বিজ্ঞানটি দেবার জন্য মানুষের বেশে ভগবান স্বয়ং আসেন। তাকে হুবহু অনুসরণ করতে হয়। এগুলি সাবধান বাণী। ভয় দেখাবার জন্য নয়। গুরু বশিষ্ঠদেব বলেছিলেন – “রাম! তুমি দেবতা হতে পার, কিন্তু ওই বিজ্ঞানে তোমাকে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে।” এই হল গুরুর কাজ। শ্রীকৃষ্ণও এই বিজ্ঞান দিয়ে গেছেন অর্জুনকে যা শ্রীগিতা নামে সুপরিচিত।[/read]

1 / 2 Next»